মহাকাশের কক্ষপথে ছুটছে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১

সংগৃহীত ছবি

তথ্যপ্রযুক্তি

মহাকাশে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু-১

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ মে, ২০১৮

অপেক্ষা শেষ। মহাকাশের কক্ষপথে ছুটছে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিটে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটটির সফল উৎক্ষেপণ হয়। উৎক্ষেপণের পর ২টা ৫৭ মিনিটে কক্ষপথে পৌঁছে স্যাটেলাইটটি। একই সঙ্গে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইটধারী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ। মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের দিকে ছুটছে দেশের প্রথম এই যোগাযোগ স্যাটেলাইট। উৎক্ষেপণের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস করপোরেশন (স্পেসএক্স) সফলতা দাবি করে বিবৃতি দেয়।

আবহাওয়াজনিত কারণে স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে উৎক্ষেপণের তারিখ আট দফা পরিবর্তন করা হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে (বাংলাদেশ সময়) উৎক্ষেপণের সব আয়োজন ঠিকঠাক থাকলেও শেষ মুহূর্তে কারিগরি জটিলতায় তা স্থগিত হয়ে যায়।

ঠিক এক দিন পর এই স্যাটেলাইটটি সফল উৎক্ষেপণ হয়। নভোযানটি ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কমপক্ষে আট দিন পর কক্ষপথে প্রবেশ করবে। বঙ্গবন্ধু-১ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের অরল্যান্ডো শহরের কেইপ ক্যানাভেরালে কেনেডি স্পেস সেন্টারের ঐতিহাসিক ‘লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯’ থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। একই লঞ্চপ্যাড থেকে ১৯৬৯ সালে চন্দ্রাভিযানে যাত্রা করেছিল ‘অ্যাপোলো-১১’। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে বঙ্গবন্ধু-১।

ফ্রান্সে নির্মিত সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের এ কৃত্রিম উপগ্রহটি রাশিয়ার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া কক্ষপথে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস কর্প। এটি ঘণ্টায় ৪০ হাজার ২৯৬ কিলোমিটারের চেয়ে কিছু বেশি গতিতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়ায় ফ্যালকন-৯ রকেটের নতুন সংস্করণ ‘ব্লক-ফাইভ’।

উৎক্ষেপণের পরপরই উৎসবে মেতে ওঠে পুরো দেশ ও প্রবাসের কোটি কোটি বাংলাদেশি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে উল্লাস প্রকাশ করে জনতা।

উপগ্রহ উৎক্ষেপণ উপলক্ষে ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামি, কোকোয়া বিচ, অরল্যান্ডোয় আনন্দ সমাবেশসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছেন প্রবাসীরা। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস, জর্জিয়াসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকেও অরল্যান্ডোতে উপস্থিত হন ইতিহাসের এই মাহেন্দ্রক্ষণ উপভোগ করতে।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহূর্তটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব কয়টি বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। বড় পর্দায় তা প্রচার করে সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলেও মুহূর্তটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এদিকে কেনেডি স্পেস সেন্টারের দুটি স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া সরাসরি দেখেন। উৎক্ষেপণের আগে স্যাটেলাইট উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারণ করা একটি বক্তব্য সম্প্রচার করে স্পেসএক্স।

উৎক্ষেপণস্থলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমসহ বিটিআরসি একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন।

স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট বা কাভারেজ এরিয়া ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। শক্তিশালী ‘কেইউ ও সি’ ব্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কাভার করবে বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত দেশগুলো এবং মিয়ানমার, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া। স্যাটেলাইটের স্থায়িত্ব ১৮ বছর হলেও রাশিয়ার কাছ থেকে কক্ষপথটি ১৫ বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

স্যাটেলাইটের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্যালেস অ্যালেনিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। প্রথম তিন বছর এই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এটির দেখভাল করা হবে। পরে পুরোপুরিভাবে দেশীয় প্রকৌশলীরা গাজীপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়া আর্থ স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।

বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু ওই আবেদনের ওপর আপত্তি জানায় ২০ দেশ, যা আজো সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ আইটিইউর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়ে একাধিকবার নীতিনির্ধারক পর্যায়ে থেকেও নিজস্ব কক্ষপথ আদায় করতে পারেনি। পরে ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়।

জাতিসংঘের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্সের (ইউএনওওএসএ) হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৩৫। প্রতিবছরই স্যাটেলাইটের এ সংখ্যা ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এসব স্যাটেলাইটের কাজের ধরনও একেক ধরনের। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি বিভিন্ন ধরনের মহাকাশ যোগাযোগের কাজে ব্যবহার হবে। এ ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ‘জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট’। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে এ স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরতে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ সম্ভব হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনায় যোগ হবে নতুন মাত্রা। স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো যাবে।

দেশের প্রথম এ স্যাটেলাইট তৈরিতে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এ ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। পুরো কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়িত হয়েছে বিটিআরসির তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এ কাজ হয়েছে। এগুলো হলো স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। তৈরি শেষে ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।

৫ মে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের কথা ছিল। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় তা পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ৭ মে এটি উৎক্ষেপণের তারিখ নির্ধারিত থাকলেও তা পিছিয়ে ১০ মে করা হয়। কারিগরি জটিলতায় উৎক্ষেপণের আগ মুহূর্তে অষ্টম দফায় স্থগিত করা হয়। ডিসেম্বরে সার্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্যাটেলাইটটি মহাকাশে যাওয়ার উপযোগী ঘোষণার পর থেকে আট দফা উৎক্ষেপণের তারিখ পেছানো হয়।

স্যাটেলাইট ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধন নিয়ে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড গঠন করা হয়েছে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এই স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। প্রযুক্তিগত সেবায় অন্য দেশের ওপর নির্ভরতা কমবে। স্থল ও জলসীমায় নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচারের নিশ্চয়তা থাকবে।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নিয়ে স্পেসএক্সের ভিডিও : 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads