নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া। হাতিয়া থেকে প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণপূর্বে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। সবুজে ঘেরা বিশালাকায় এক ভূখণ্ড। বিদায়ী শতাব্দীর ১৯৫০ সালে সাগরে জেগে ওঠা এই চর প্রথমে জেলেদের দৃষ্টিতে আসে। তারও ১৯ বছর পর ১৯৬৯ সালে সাগরের বুকে জেগে ওঠা চরভূমি জরিপ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। জরিপদল সেখানে গিয়ে দেখা পায় মহিষ রাখাল ওসমানের। তাৎক্ষণিকভাবে রাখাল ওসমানের নামে ওই চরের নামকরণ করা হয়। যা বন বিভাগে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে।
সাগরের বুকে জেগে ওঠা ওই চরভূমির আয়তন প্রথমে ঠিক কত ছিল তা জানা যায়নি। সর্বশেষ হিসাবে এই দ্বীপের আয়তন ২ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার। স্বাধীনতার পর নোয়াখালীর তৎকালীন কৃষি প্রতিমন্ত্রী আমিনুল ইসলাম (কালাম সাব) এই দ্বীপের নামকরণ করেন নিঝুম দ্বীপ। ওই নামে এই দ্বীপভূমি এখন দেশে-বিদেশে পরিচিত।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ভূমিহীন পরিবারের এখানে বসতি শুরু হয়। এক বছর পর ১৯৭৪ সালে এই দ্বীপের ৪০ হাজার একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করে সরকার। লাগানো হয় কেওড়া, বাইন, বাবলা, করমজাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।
১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিঝুম দ্বীপে এসে সৃজিত বনে অবমুক্ত করেন ৫ জোড়া চিত্রা হরিণ। বর্তমানে সৃজিত এই বনে হরিণের সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। বন বিভাগের কর্মচারীরা জানান, হরিণের পাশাপাশি সমুদ্রে নিরাপদে বিচরণ করে বিলুপ্তপ্রায় গ্যান্ডেলিক ডলফিন। বনে ৬৬ প্রজাতির গাছ, ১১৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ৮০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। সরকার সৃজিত এই দ্বীপের বনভূমি এখন অপার সৌন্দর্যের ক্ষেত্র। দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক ছুটে আসেন এই সাগরদ্বীপের অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
নিঝুম দ্বীপের ২৫ হাজার একর খাসজমিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ ঘরবাড়ি। জনসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। রয়েছে দুটি বাজার, দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার ৮টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, একটি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি ইউনিয়ন পরিষদ। দ্বীপের ৭৫ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী ও ২৫ ভাগ কৃষিজীবী। ২০০৬ সালে নিঝুম দ্বীপকে নতুন ইউনিয়ন করা হয়। একসময় জাহাজমারা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড ছিল এটি। ২০০৬ সালে নতুন ইউনিয়ন হয় নিঝুম দ্বীপ।
খাসজমিতে বসতি গড়ে ওঠা নিয়ে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার জানান, কিছু খাসজমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। বাকিটা হরিণ ও বন্যপ্রাণীর জন্য থাকবে। তদারকি করবে বন বিভাগ।
অপরূপ এই সাগরকন্যার বিশেষ বাসিন্দা চিত্রা হরিণ। এর সংখ্যা এখন আনুমানিক ৪৫ হাজার। ১৯৭৮ সালে ছাড়া ৫ জোড়া চিত্রা হরিণের বংশবৃদ্ধি হয়ে সর্বশেষ এই সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে। পর্যটকরা খুব কাছ থেকে চিত্রা হরিণ দলের বিচরণ দেখার সুযোগ পান। চঞ্চল স্বভাবের মায়াবী প্রাণীটির দল বেেঁধ ঘুরে বেড়ানো এ দ্বীপের স্বাভাবিক দৃশ্য। বনের ভেতরে ছাড়াও হরিণের দল দেখতে পাওয়া যায় সাগরকুলের নানা পয়েন্টে।
নিঝুম দ্বীপের বাসিন্দা এই প্রাণীটির জীবন এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। খাদ্য সঙ্কট, বুনো কুকুরের আক্রমণ, মিঠাপানির স্বল্পতা, শিকারিদের দৌরাত্ম্য, রেঞ্জ কর্মকর্তাদের অবহেলা, এলাকাবাসী ও ভূমিদস্যুদের বৃক্ষনিধন এবং বনভূমি দখলে মায়াবী এ হরিণের জীবন হয়ে উঠেছে বিপন্ন।
নিঝুম দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, খাবারের পাশাপাশি সুপেয় খাবার পানির সঙ্কটেও রয়েছে এ দ্বীপের হরিণ। চারপাশজুড়ে সাগরে পানির ছড়াছড়ি থাকলেও হরিণ তা পান করে না। এ সঙ্কট কাটাতে বনে দুটি মিষ্টি পানির পুকুর খনন করেছে উপজেলা পরিষদ। দুই পুকুরের অবস্থা এখন অনেকটাই বেহাল। পলি জমে ভরাট হওয়ার উপক্রম। গ্রীষ্মে পানি থাকে না পুকুরে। তেষ্টা মেটাতে প্রতিদিনই হরিণের পাল ছুটে আসে নদীর তীরে। তখন স্থানীয়রা হরিণের পালকে ধাওয়া করে। অনেক সময় সফল হয়। বনদস্যুরা রাতের আঁধারে হরিণ নিধন করে নির্বিচারে। কখনো গুলি করে, অনেক সময় ফাঁদ পাতে। বিক্রি করে নোয়াখালীসহ আশপাশের জেলায়। হরিণের মাংস এখানে সহজলভ্য।
বিশাল আয়তনের নিঝুম দ্বীপ দেখভালে নিয়োজিত মাত্র ৭ প্রহরী। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে হরিণ বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আশ্রয় নেওয়ার মতো নেই কোনো উঁচু জায়গা। তাই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক হরিণ ভেসে যায় সাগরের জলে।
আশার কথা হচ্ছে, এই সাগরকন্যার অপরূপ সৌন্দর্যে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। নিঝুম দ্বীপে পর্যটক আকর্ষণে ৪৮ কোটি ৭৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকার প্রকল্প নিয়েছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুমোদনও দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ তথ্য জানান নিঝুম দ্বীপ বিটের বন কর্মকর্তা মো. জাবের হোসেন।
সম্প্রতি সাগরদ্বীপ ঘুরে গেছেন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তার কথায়ও ছিল এই দ্বীপ উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপের প্রতিধ্বনি। জানান এই দ্বীপ ঘিরে সরকারের পরিকল্পনার কথা। পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্রসহ নানা উন্নয়নের কথা। বললেন, শিগগির কাজ শুরু হবে।