উমর ফারুক মাসরুর
কাবা- কালো গিলাফ আবৃত একটি পবিত্র ঘর। পৃথিবীর সেরা ঘর। আল্লাহর ঘর। প্রতিনিয়ত যে ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে লক্ষকোটি মানুষ নিজ প্রভু পালনকর্তার সামনে মাথা নত করছে। সেই কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার ঘরের দুয়ারে নিজের উপস্থিতি কতই না সৌভাগ্যের। এটি সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত। একে বায়তুল আতিক বা বায়তুল হারামও বলা হয়। পবিত্র হজ এবং ওমরা পালনের উদ্দেশে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মুসলমানরা এই পবিত্র ঘর তাওয়াফ করেন। হজ ইসলামের আবশ্য পালনীয় একটি আমল। ফরজ আমল। ইসলামের পঞ্চম ভিত্তি। তাই একে অস্বীকার করা কুফরি। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির সমন্বয়ে এক যৌগিক ইবাদতের নাম হজ। এটি সবার ওপর ফরজ নয়। কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণের সম্পদশালী হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির জন্য জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এটি ফরজ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। হিজরি সনের জিলহজ মাসে এটি পালিত হয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর; মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা বিশ্বের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মোকামে ইব্রাহিমের মতো সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরে হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯৬ ও ৯৭)
জিলহজের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সময়ে ৩টি ফরজ, ৫টি ওয়াজিব এবং সুনির্দিষ্ট কিছু সুন্নাত আমল পালনের মাধ্যমে হজ সম্পাদন করতে হয়। এগুলো পবিত্র নগরী মক্কা, আরাফা, মিনা, মুজদালিফায় মহান আল্লাহর নিদর্শনগুলোতে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সম্পাদনের মাধ্যমে পূর্ণ হয় হজ। হজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সঙ্গে তৈরি হয় বান্দার ঐকান্তিক সুসম্পর্ক। বান্দা তার গোনা মাফ করিয়ে হয়ে ওঠে সদ্য ভূমিষ্ঠ নিষ্পাপ শিশুর মতো।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গোনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমন অবস্থায় ফিরে আসে, যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তদ্রূপই হয়ে যায়।’ (বুখারি-১৫২১ ) সামর্থ্যবানদের মধ্যে যাদের ওপর হজ আদায় করা ফরজ হয়েছে অথচ হজ আদায় থেকে তারা নিজেদের বিরত রেখেছেন, তাদের সম্পর্কে প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) হাদিসে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এই পরিমাণ পাথেয় এবং বাহনের মালিক হয়েছে; যা তাকে আল্লাহতায়ালার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, অথচ সে হজ করেনি। ওই ব্যক্তি ইয়াহুদি কিংবা নাসার হয়ে মৃত্যুবরণ করুক, এতে (আল্লাহর) কিছু যায় আসে না। আর এটা ওই কারণে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মানুষের প্রতি আল্লাহর উদ্দেশে বায়তুল্লাহর হজ ফরজ; যে ব্যক্তি সেই (বায়তুল্লাহ) পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য লাভ করেছে।’ (তিরমিজি)
হজ ও ওমরা পালনে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক প্রতিদান ঘোষিত রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করা হলো সর্বোত্তম আমল কোনটি? জবাবে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনা। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো তারপর কোন আমল?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ আবার জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোন আমল? জবাবে তিনি বললেন, ‘মাবরূর হজ।’ (বুখারি-৬, ১৫১৯ ও মুসলিম-৮৩) হাজী সাহেবগণ আল্লাহর মেহমান। তারা দোয়া করলে তা কবুল হয়ে যায়। ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে, রসুল (সা.) বলেছেন, হজ ও ওমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। তারা দোয়া করলে তা কবুল হয়ে যায় এবং গোনাহ মাফ চাইলে তা মাফ করে দেয়। (ইবনে মাজাহ-২৮৯২) হজ-ওমরা নারী ও বয়স্কদের জন্য জিহাদতুল ইবাদাত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বয়স্ক, শিশু, দুর্বল ও নারীর জিহাদ হলো হজ এবং ওমরা পালন করা।’ (নাসাঈ-২৬২৬) হজ আমল পালনকারীর জন্য রয়েছে জান্নাত। হাদিসে এসেছে, হজরত জাবের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘এ (কাবা) ঘর ইসলামের স্তম্ভস্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি হজ কিংবা ওমরা পালনের জন্য এ ঘরের উদ্দেশে বের হবে, সে আল্লাহতায়ালার জিম্মাদারিতে থাকবে। এ পথে তার মৃত্যু হলে আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। আর বাড়িতে ফিরে আসার তাওফিক দিলে তাকে প্রতিদান ও গণিমত দিয়ে প্রত্যাবর্তন করাবেন।’
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, ঢাকা