সিজোফ্রেনিয়া : আপন বৃত্তে বন্দি মানুষ

সিজোফ্রেনিয়া রোগের সঠিক কারণ আজো জানা যায়নি

ছবি : ইন্টারনেট

ফিচার

সিজোফ্রেনিয়া : আপন বৃত্তে বন্দি মানুষ

  • প্রকাশিত ২ অগাস্ট, ২০১৮

ডা. মো. জিল্লুর কামাল

প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

সিজোফ্রেনিয়া রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে ভ্রান্ত বিশ্বাস, অলীক শব্দ শোনা, দৃষ্টি বিভ্রম, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই তার চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকা, অযথাই কাউকে সন্দেহ করা এবং সেই সন্দেহ মতো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা, নিজেকে এমন তুচ্ছ ভাবা যে সামজিক কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে ফেলা অথবা এত মহৎ-জ্ঞানী-গুণী-ক্ষমতাবান ভাবা যে কাউকেই তেমন পাত্তা না দেওয়া। এসব প্রাথমিক লক্ষণ হলেও সিজোফ্রেনিয়া অত্যন্ত জটিল একটি শারীরিক ও মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগী যেমন ভোগেন, তার পরিবারকেও দ্বিগুণ ভোগান্তি পোহাতে হয়। সঠিক চিকিৎসা, ধৈর্য, নিজের প্রতি যত্ন, জীবনের প্রতি ভালোবাসাই এ রোগ থেকে রোগীকে সুস্থ জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে পারে।

যেকোনো জনগোষ্ঠীর শতকরা একজন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সেই হিসেবে বাংলাদেশে মোট সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ত্রিশ হাজার। নারী-পুরুষ সমভাবে এ রোগে আক্রান্ত হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার বয়স সাধারণত ১৬ থেকে ২০ বছর। মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু বেশি, ২০ থেকে ৩০ বছর।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের সঠিক কারণ আজো জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন প্রকার গবেষণার মাধ্যমে সিজোফ্রেনিয়া রোগের সম্ভাব্য কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- মস্তিষ্কের রসায়নে পরিবর্তন, গুরু মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের তারতম্য, মলিকুলার বায়োলজি, বংশগতি, মানসিক চাপ, মাদকাসক্তি, পুষ্টিতত্ত্ব।

সিজোফ্রেনিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দমূল ঝশযরুবরহ (ঃড় ঝঢ়ষরঃ বা বিভক্ত করা) এবং ঢ়যৎবহড়ং (সরহফ বা মন) থেকে। রোগাক্রান্তের পরিবার এবং পরিচিতরা সমস্যায় পড়ে যান রোগীর অদ্ভুত আচরণ দেখে। তাদের সঙ্গে মানিয়ে চলাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই রোগকে অনেক সময় মানসিক রোগের ক্যানসার হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। রোগীটির প্রভাব এত ব্যাপক যে, কেউ যদি অস্বাভাবিক আচরণ করে তাহলে তাকে হেয় করতে অনেকে বলেন- কী, সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে নাকি! অনেকে একে শুদ্ধ উচ্চারণে বলেন, স্কিৎজোফ্রেনিয়া। আমাদের দেশে সিজোফ্রেনিয়া নামেই পরিচিতি পেয়ে গেছে। নামে পরিচিত হলেও এ রোগটি সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই।

১৮৮৭ সালে ড. এমিলি ক্রেপলিন সর্বপ্রথম এই রোগ সম্পর্কে জানান। তার গবেষণা থেকে জানা যায়, মানবজাতির বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে এই রোগ স্থান করে নিয়েছে। বেশিদিন আগে আবিষ্কৃত না হলেও এই রোগটি সবচেয়ে পুরনো রোগগুলোর একটি। বিভিন্ন পুরনো নথিপত্র থেকে প্রাচীন মিসরে পর্যন্ত এই রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য সেই সম​য়ে এই রোগটিকে শ​য়তান বা ভূতে পাওয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো​। এই রোগের কারণেই ভূত-প্রেতবিষ​য়ক কুসংস্কারগুলো উৎপন্ন হ​য়েছে বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন।

সিজোফ্রেনিয়া অনেক প্রকারের হতে পারে

১. প্যারান​য়েড সিজোফ্রেনিয়া- অকারণ বিভ্রম বা হ্যাল্যুসিনেশনের ফলে ভয় পাওয়া।

২. ডিস​অর্গানাইজড সিজোফ্রেনিয়া- এর ফলে অসংলগ্ন কথাবার্তা, খাপছাড়া কথাবার্তা ইত্যাদি দেখা যায়।

৩. ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া- এর ফলে রোগীর পেশি চালনার ভঙ্গিটিও অস্বাভাবিক হ​য়, যেমন- হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যাওয়া, অকারণে মারামারি, অন্যরা যা বলছে তা বার বার বলতে থাকা ইত্যাদি।

৪. আনডিফারেনশিয়েটেড সিজোফ্রেনিয়া- এর ফলে রোগী অস্বাভাবিকভাবে নির্বিকার হ​য়ে যায় অর্থাৎ যেসব কথায় অন্যরা কোন আচরণ প্রত্যাশা করে সেক্ষেত্রে হঠাৎ চুপ করে যাওয়া।

৫. অন্যান্য সিজোফ্রেনিয়া- যেমন বিভ্রম, প্যারান​য়া, সন্দেহপ্রবণতা, প্রচণ্ড ভায়োলেন্ট হ​য়ে যাওয়া ইত্যাদি।

চিকিৎসা- ওষুধ ও অন্যান্য থেরাপিগত পদ্ধতির সমন্বয়ে সিজোফ্রেনিয়া রোগের চিকিৎসা করা হয়। ১৯৫০-এর দশকে সিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ আবিষ্কারের পর সিজোফ্রেনিয়া রোগের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে গেছে। বর্তমানে সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার জন্য অনেক ভালো ওষুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গবেষণাধীন আছে আরো অনেক ওষুধ। আশা করা যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীদের আরো ভালোভাবে জীবনযাপনে সক্ষম করে তোলা সম্ভব হবে। তবে সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে বেশি দরকার পারিবারিক সেবাযত্ন এবং প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য। যারা রাসেল ক্রো অভিনীতি ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবিটি দেখেছেন তারা জানেন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও জীবন কী রকম মহৎ ও সুন্দর হতে পারে। রাসেল ক্রো এ ছবিতে অভিনয় করেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন নাশের চরিত্রে। প্যারান​য়েড সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। চোখের সামনেই তিনি এমন মানুষ দেখতে পেতেন, যারা তাকে হত্যা করার জন্য তাড়া করছে। জন নাশের স্ত্রী তাকে বুঝান, এসব মিথ্যা, সত্য নয়, তুমি অসুস্থ। জন নাশও তা বিশ্বাস করেন, কিন্তু চোখের সামনে তাও তার শত্রুদের দেখতে পান। সেসব নিয়েই তিনি গেম থিউরি নামে অর্থনীতিতে অসামান্য এক অবদান রাখেন, যার জন্য ১৯৯৪ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। মনে সাহস আর ধৈর্য থাকলে কোনো রোগই মানুষকে দমাতে পারে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads