ফারজানা বীথি
সিজারিয়ান ডেলিভারি নিয়ে সাধারণত মায়েদের নানা ধরনের ভীতি কাজ করে। এই ভীতি প্রসব-পরবর্তী মানসিক অবস্থার ওপর চাপ ফেলে। তাই এ সময় সিজারিয়ান মায়েদের মানসিক যত্নের বিশেষ প্রয়োজন।
ডেলিভারির পর, বিশেষ করে সিজারের ৪-৫ দিনের মাথায় ইমোশনাল ব্রেকডাউন হয়। একটুতেই খারাপ লাগে, কান্না পায়, দুর্বল লাগে এবং ঠিকমতো চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না। সিজারের পর শারীরিক দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা, বিশেষ করে ঘাড় ব্যথা, কোমর ব্যথা এবং স্থায়ী স্থূলতার দুশ্চিন্তায় ভোগেন। অনেকেই নরমাল ডেলিভারি হয়নি বলে মন খারাপ করে থাকেন বা নিজেকে অযোগ্য বলে ভাবতে থাকেন। এসব অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় মায়েদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বাচ্চার দেখাশোনা এবং ভবিষ্যতের বেশকিছু দুশ্চিন্তা যেন মা-কে বিমর্ষ করে না ফেলে, তার জন্য বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। কিছু কিছু মা হয়তো প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই মা-কে পরিবারের অন্যদের এবং একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। বাবা ও পরিবারের অন্যদের সহযোগিতা বিশেষভাবে কাম্য এ সময়টিতে।
সন্তান জন্মদানজনিত শারীরিক ধকল, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব এবং হরমোনের বিভিন্ন জানা-অজানা প্রভাবের কারণে মায়েরা একটু খিটখিটে আচরণ করতে পারেন, তুচ্ছ কারণে অভিমান বা কান্নাকাটি করতে পারেন। এগুলোকে সাধারণত বেবি ব্লুস (Baby Blues) বলা হয়, যা সাধারণত শিশুর জন্মের এক-দেড় মাসের মধ্যে কেটে যায়। তবে বিষয়টি আর বেবি ব্লুসের পর্যায়ে থাকে না, যখন এসব সমস্যা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়; যেমন- মা-কে ভয়াবহ আত্মগ্লানি ও বিষণ্নতা গ্রাস করে এবং বিষয়গুলো দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে কিংবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। তখন একে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা বা পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন বলে।
মায়েদের এ ধরনের সমস্যা হলে তাকে যথাসম্ভব মানসিক সাপোর্ট দিন। বিশেষ করে বাবাদের অবদান এসব ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রসূতি যদি বেবি ব্লুসজনিত খিটখিটে আচরণ করেন, তাহলে তাকে ভরসা দিন, তাকে কিছুদিনের জন্য Judge করবেন না। সবসময় ধৈর্য রাখা পরিবারের অন্যদের জন্য খানিকটা চ্যালেঞ্জিং, তবে নবজাতক এবং মায়ের স্বার্থে তাদের সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা বা পোস্টপারটাম ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে স্বামী কিংবা পরিবারের অন্যদের বিশেষভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে; যেমন- মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মা-কে সবসময় মোটিভেটেড রাখা, তার বিভিন্ন কাজের প্রশংসা করা, এমনকি তার অন্যায্য কোনো ব্যবহারের সমালোচনা না করে ঠান্ডা মাথায় তাকে শান্ত করা এবং যথাসম্ভব সঙ্গ দেওয়া। একা মায়েদের ক্ষেত্রে কিংবা একক পরিবারে বিষয়টি অনেকটা কঠিন হয়, যে কারণে গর্ভাবস্থায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্ল্যান করে রাখা দরকার।
আপনি যদি নতুন মা হন, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে অন্যের সাহায্য নিন। অন্যেরা আপনার ওপর বিরক্ত হচ্ছেন কি-না, আপনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন কি-না, কেউ নিজে থেকে আপনাকে কেয়ার করছেন না কেন ইত্যাদি চিন্তা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখার চেষ্টা করুন। সেই সঙ্গে আপনার সমস্যা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করলে তারা আপনার সম্পর্কে কী ধারণা করবে- এ ধরনের চিন্তা বাদ না দিলে সমস্যা বরং আরো বাড়বে। সমস্যা শেয়ার করুন এবং সাহায্য চান। মনে রাখবেন এ সমস্যাটি আপনার একার নয়, বরং পরিবারের সবার।
বাচ্চাকে স্ট্রলারে বসিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। অথবা বান্ধবীর সঙ্গে কাছের কোনো কফি শপে গিয়ে কথা বলে আসুন। বাইরের খোলা বাতাস, সূর্যের আলো, আলাপ-আলোচনা সবই আপনার ও বাচ্চার জন্য ভালো। যদি বাইরে ঘুরে আসা আপনার জন্য কঠিন হয়, তাহলে বাসার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান, গভীরভাবে শ্বাস নিন, সূর্যালোক উপভোগ করুন। এগুলো মনকে হালকা করবে।
একজন মা হিসেবে আপনার নিজের এবং শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল আপনাকেই রাখতে হবে। প্রয়োজনে নিজেই প্রসব-পরবর্তী সময়ে ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে ঘুরে কিছুটা পড়াশোনা করে জেনে নিন। এটি আপনাকে অনেকটা মানসিক চাপমুক্ত রাখবে। আত্মসচেতন হওয়া মায়ের জন্য খুবই দরকার। আপনার মানসিক অবস্থা আপনিই ভালো বুঝতে পারবেন। যদি প্রয়োজন মনে করেন কনসালট্যান্টের কাছে যেতে পারেন। আপনার শিশুর আপনাকে দরকার এবং নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ঠিক রাখাই আপনার সবচেয়ে বড় কাজ। যেটা পারছেন না, যেটা হচ্ছেই না, তার জন্য হতাশ না হয়ে বিকল্প উপায়ে অগ্রসর হোন এবং সেই সঙ্গে চেষ্টাও চালিয়ে যান।