সাভারে তামা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের গহনা

দেখতে সোনার মতো হলেও এগুলো সিটি গোল্ড বা ইমিটেশন নামে পরিচিত

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

সম্ভাবনা

সাভারে তামা দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের গহনা

  • প্রকাশিত ১ অগাস্ট, ২০১৮

আরিফুর রহমান, সাভার

গহনা বলতেই আমরা মনে করি সোনা-রুপার তৈরি বাহারি ডিজাইনের গহনার কথা। কিন্তু স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে সাভারের ভাকুর্তা বাজার ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে গহনা তৈরি করা হয় তামা ও পিতল দিয়ে। প্রাথমিকভাবে এগুলো অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে পরিশোধন ও রঙ করে বাজারে বিক্রি করেন। দেখতে সোনার মতো হলেও এগুলো সিটি গোল্ড বা ইমিটেশন নামে পরিচিত। এখানে তামার ব্যবহার বেশি হলেও পিতল ও দস্তা দিয়েও গহনা তৈরি করেন কারিগররা।

জানা যায়, আশির দশকেও এই বাজারে সোনা ও রুপার গহনা তৈরি হতো। কিন্তু এগুলোর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী ও কারিগররা তা থেকে সরে আসেন। নব্বইয়ের দশকে এসে ঝুঁকে পড়েন ইমিটেশনের গহনা তৈরির দিকে।

রাজধানী ঢাকার গা ঘেঁষে মোহাম্মদপুর, আদাবর ভেড়িবাঁধের ওপারে তুরাগ নদী পেরিয়ে সাভার উপজেলার একটি ইউনিয়ন ভাকুর্তা। সাভারের এক সময়কার অবহেলিত জনপদ এটি। শিক্ষায় তারা পিছিয়ে ছিল। বেকার জীবনের গ্লানিতে দিন কাটত যাদের, তাদের কেউ এখন বেকার ঘরে বসে নেই। ছোট-বড় নারী-পুরুষ অনেকেই ব্যস্ত তামা ও পিতল দিয়ে গহনা তৈরিতে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সুনসান শব্দে নানা ধরনের গহনা তৈরিই এখন তাদের পেশা। এ ইউনিয়নে রয়েছে ৩০টি গ্রাম। গ্রামগুলোতে বসবাস করা মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস গহনা তৈরি করা। নারী-পুরুষ মিলে মেয়েদের গহনা তৈরি করেন। এই গহনা বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এখানকার কারিগররা বেশিরভাগ সোনা ও রুপার দোকানে কাজ করে বিভিন্ন ডিজাইনের কৌশল রপ্ত করেছেন। পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গহনাও এখানে তৈরি করা হয়। ভাকুর্তা বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাকা, আধাপাকা, কিছু টিনের ঘরে বসে দিব্যি কাজ করছেন বিভিন্ন বয়সী কারিগর ও সহকারীরা। কারিগররা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তৈরি করছেন গলা, নাক, কান, পা, কোমর, মাথার বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা। সোনার দোকানে যে সব জিনিস থাকে, তার যেন সবই রয়েছে ঘরগুলোতে। সামনে, পেছনে, দেয়ালে থরে থরে সাজানো মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের গহনা।

আমেনা জুয়েলারি ওয়ার্কশপের মালিক মো. সাদেক মিয়া জানান, গহনা তৈরির কাজটি আগে হিন্দুরা করতেন। মুসলমানরাও এটাকে এখন পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি জানান, তাদের তৈরি গহনাগুলো পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় ২০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। দাম ডিজাইন ও আকারের ওপর নির্ভর করে। যেমন গলার নেকলেস ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চুড়ি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা জোড়া, শিতাহার ৬০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা, নুপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার ঝাপটা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, হাতের মালতাশা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, খোঁপার কাঁটা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার টায়রা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, শাড়ির মালা ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, নাকের ফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, কপালের টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এসব গহনা অপরিশোধিত অবস্থায় বিক্রি হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে পরিশোধন করে যখন মার্কেটে খুচরা বিক্রি করেন। তখন এর দাম দাঁড়ায় দেড় থেকে দুইগুণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ভাকুর্তা বাজারের কারিগর বেচারাম দেওড়ি জানান, গহনা তৈরির কাঁচামাল তামা কিনে নিয়ে আসা হয় ঢাকার কোতোয়ালি থানার তাঁতীবাজার থেকে। দাম পড়ে কেজিপ্রতি ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া কিছু গহনার কাঁচামাল বগুড়া ও ভারত থেকে আনা হয়। নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করেন কারিগররা।  দিনে ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করে আয় হয় মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

ভাকুর্তা বাজারের স্বর্ণ, রোপ্য ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানান, ভাকুর্তা বাজারের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। এ বাজারে দোকান রয়েছে ১৩০ টির মতো। আর ভাকুর্তা ইউনিয়নে কমপক্ষে ২৫০টি থেকে ৩০০টি দোকান। ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ এই পেশায় জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য এই পেশায় জড়িত রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সব বড় বড় শপিং মল, ঢাকার নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, চাঁদনীচকসহ সব মার্কেটের গহনা যায় ভাকুর্তা থেকে। মার্কেটগুলোতে সিটি গোল্ড বা এন্টিক নামে এসব গহনা বিক্রি হয়। শুধু দেশে নয়, এখানকার গহনার চাহিদা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশে। তিনি বলেন, ঢাকা ও দেশের বিভন্ন জায়গায় যে সব ইমিটেশন বা সিটি গোল্ডের গহনা বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই এখানকার তৈরি। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, ইতালিতেও কিছু কিছু রফতানি হয়। সরকার যদি আর্থিক সহযোগিতা করে তাহলে ভাকুর্তার এই ইমিটেশন শিল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads