ঘরের চার দেয়ালে বন্দি। খেলার মাঠগুলো খাঁখাঁ করছে। পুকুরে নেই গোসলের ফালাফালি। ঘোরাঘুরি বন্ধ। নেই জীবনের ছন্দ। বয়ে যাওয়া নদীটিও হয়ে গেছে নিরিবিলি-শান্ত-স্থির। জীবনের প্রাচীরে লেগেছে ধাক্কা। আনন্দে চলা পথটি চমকে গিয়ে হলো বাঁকা। দেহ ও মন পড়েছে কঠিন পীড়ায়। এ পীড়া সময়কে দিয়েছে থমকে। চলাকে করেছে স্থবির। ঘরে থাকলেই নিরাপদ—এ কথাটি কে বোঝে না? সবাই বুঝলেও মানতে নারাজ। কারণ? কারণ আর কি, ক্ষুধা আর তৃষ্ণা। বাইরে না গেলে চলে না। জীবন ও জীবিকার এ যুদ্ধ থামবে না সত্য। থামানো সম্ভবও হচ্ছে না। বাইরে গেলেই জীবনের ঝুঁকি। এক বছর আগেও কর্মচঞ্চলতায় মুখর ছিল এদেশ। আজ সবকিছু থেমে গেছে। থমকে গেছে। এ জাতি থামতে জানে না। আর তাই তো বাইরে বের হয়ে লাঠিপেটা এবং কান ধরে উঠবোস করার মতো নির্লজ্জ ঘটনাও ঘটছে। বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। তাই বাইরে না গেলে চলবেই না। বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গেলেও মাস্ক পরতে হবে। তাই মাস্ক না পরার প্রচেষ্টা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, অথচ দূরত্বের সীমা বা পরিসীমার ধারণাও অনেকেরই নেই জানা। সরকারের বিপরীতে যাওয়া যেন জনগণের এটা বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
একদিন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হলাম, যা দেখলাম তাতে বিস্মিত! একজন মাস্ক মুখের নিচে নামিয়ে সিগারেট ফুঁকছেন। সিগারেট পান করার গুণ আর মুখে মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা উনি জানেন না, উনাকে দেখে তা মনে হয় না। আরেকজনকে দেখলাম, মোটরসাইকেলে মুখে মাস্কও আছে অথচ মাথায় হেলমেট নেই। আবার তিনজন চড়েছে। মাস্কের দরকার ও হেলমেট মাথায় থাকার গুণগত দিক উনি বোঝেন না এটাও নয়। আরেকজনকে দেখলাম, হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরে আনমনা হয়ে উদাসী ভাবনায় রাস্তার দুপাশের সব দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। হঠাৎ দড়াম করে আওয়াজ হলো দৌড়ে গেলাম। কী আজব ব্যাপার, জন-মানব প্রায় শূন্য রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট। কথা বলে জানতে পারলাম, কয়েকদিন থেকে বাসায় বসে থেকে বিরক্ত, তাই রাস্তায় ঢু মারতে বের হয়েছেন। বাজার করছি হঠাৎ পুলিশ ভাইয়েরা হাজির। বাজারটা অল্প সময়ের ব্যবধানে সরগরম হয়ে গেল। মুখে মাস্ক পরার হিড়িক। দূরত্ব বজায় রাখার ফিকির। তাজ্জব ব্যাপার-স্যাপার। আমরা মাস্ক ব্যবহার না করলে কিংবা নিরাপদ দূরত্ব বা হাঁচি, কাশির সময় শিষ্টাচার না মানলে ক্ষতি কার? এর উত্তর উনারা জানেন না এটাও ঠিক নয়। শুধু মানতে নারাজ। নিয়ম ভাঙার জন্য যদি কোনোদিন নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় তবে হলফ করে বলতে পারি সে পুরস্কার বাংলাদেশেরই প্রাপ্য। দেশের সমঝদার ব্যক্তিরা নিয়মের টুঁটি ধরে চেপে মারবার উপক্রমও কম করেন না! এটা আসলে কিছু নয়! এটা যে আমাদের বহু সময়ের শিক্ষা।
এদেশে ভাইরাস এসেছে। গোটা বিশ্বই করোনার ভয়ে ও ভারে জর্জরিত। বাঙালিরা সবই পারে। না পারার তালিকা খুব ছোটই হবে। আমাদের ফুটানির কমতি নেই। আমাদের চাওয়া ও পাওয়া বড়ই অদ্ভুত! আমাদের সরকার বাহাদুর অনেক কিছুই চেষ্টা করেন; কিন্তু তা সফল হয় কতটুকু! লকডাউন শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে একটি আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদেশ তো দারিদ্র্যের দেশ। খেটে খাওয়া মানুষের দেশ। অবশ্য এদেশে টাকাওয়ালার সংখ্যাও আছে, যা গুনে দেখা যায়। গরিবের মাঝে গরিব মানুষের সংখ্যাও নিতান্তই কম নয়। জীবনের চাইতে জীবিকার মূল্য অনেকের কাছে বেশি। তাই এদেশে লকডাউনের মতো শক্ত শব্দটি তেমনভাবে প্রযুক্ত হয় না।
আহ, কী মজার ছুটি! ছুটি মানেই গ্রামে ফেরা। ব্যস! বাস, ট্রেন, লঞ্চের সব জায়গায় চলল কাছাকাছি যাবার সুবর্ণ সুযোগ। কীসের নিরাপদ দূরত্ব? কীসের শিষ্টাচার? কীসের করোনা? আর কীসের সংক্রমণ? সেদিন সবই উবে গিয়েছিল। গ্রামে ফেরার হইহুল্লোড়, গাড়িগুলোতে গাদাগাদি করে যাওয়া। এই দৃশ্য যে ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার মতো। এর ভয়াবহতা যে কী হতে পারে তা সময়ের কাছে রেখে দিলাম। প্রাণের টানে মায়াবী বাঁধনে বাঁধতে গ্রামে ফেরা হলেও এটা কোনো সচেতন, বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। বর্তমানের করোনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচার জন্য যখন বিশ্ব টালমাটাল। বাংলাদেশের মানুষগুলোর কাছে এর কোনো প্রায়োগিক দিক আছে বলে মনে হয় না। তাই বিশ্বাস করি আইন প্রয়োগে যতটা না কাজ হবে, তার চেয়ে ঢের বেশি হবে সচেতনতাই। তবে জীবন ডাউনে থাকা মানুষগুলোর কাছে যে জীবনের চেয়ে জীবিকার দামটাই বেশি। বলা দরকার, তারা যদি নিজেদের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি পায়, তবে বলা যায় তারা ঘর থেকে বের হবে না। প্রায় সতেরো কোটি মানুষের জন্য এমন ভাবনা ভাবাও যে অলীক স্বপ্ন মাত্র। আর তা সরকারের একার পক্ষে করাটাও প্রায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে টাকার পাহাড় গড়া মানুষদের এগিয়ে আসলে বোধকরি কাজটি অনেকাংশেই সহজ হবে। পরিতাপের বিষয়, এমন দেশপ্রেমিক ও দরিদ্রপ্রেমিক মানুষ কোথায়?
যে যেখানে আছো, সে সেখানে থাকো-দেশের বাড়ি, এমনকি পাশের বাড়িতেও যাওয়া যাবে না। এই নীতিকে কঠোরভাবে মেনে তা পর্যবেক্ষণে রাখলে ভালো হতো। তা তো হলো না। লকডাউনের আগে গোটা দেশে যে মহড়া, বাড়ি ফেরার যে কুকাওয়াজ হলো তা কিন্তু সুখকর হয়নি। বাঙালি মানেই আবেগী। সব জায়গায় আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। শহরেই সব শিল্প-কারখানা। গ্রামকে শহরের মাঝে মিশিয়ে দেওয়া স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সম্ভব হয়নি। আর তাই তো লকডাউনে দেখি গ্রামের ফেরা আবেগী মানুষগুলো নিজেকে ধরে তো রাখেনি বরং নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বলাকা মনে করে ঘুরছেন, গল্প-গুজবে সময় পার করছেন এটা কত ক্ষতির কারণ তা আর কাকে বলি?
মনে হয়, কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, করোনা কীভাবে ছড়ায় ও এর প্রতিকার সম্বন্ধে জানেন না। তবে কেন দেশের সাধারণ মানুষগুলো বার বার ভুল করছেন? এ ভুলগুলো যে পরে জীবননাশের জন্য পর্যাপ্ত হয়ে যাবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, করোনার রূপ ভয়ংকর হলে তা দৃশ্যমান হতে সময় নেয় না। অতঃপর মৃত্যু নামক দানব এসে নিয়ে চলে যায় অজানা রাজ্যে। ভাবুন, শুধু সাবধানতার জন্য আপনার, আমার, সবার মূল্যবান জীবন বেঁচে যাবে। ঘরই এখন নিরাপদ আশ্রয়। ঘরের মধ্যেই আছে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। ঘরে থাকতে থাকতে বিতৃষ্ণা জাগতেই পারে। তা দূর করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ুন, সাহিত্য পড়ুন। যাদের লেখালেখির অভ্যেস আছে তারা লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে পারেন। টিভি, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন তো আছেই। পরিবারকে সময় দিন, সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা যেতে পারে। এতদিন বাড়িতে সময় দিতে পারেননি। আজ সৃষ্টিকর্তাই আমাদের সুযোগ করে দিয়েছেন। সে সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো ঠিক হবে না। অসহায়দের বুকের ভেতরে বয়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসের দিঘল যন্ত্রণাগুলোকে দূর করার দায় ও দায়িত্ব নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যারা দাঁড়িয়েছেন বুকভরা ভালোবাসা তাদের জন্য।
লেখক: গোলাম মোর্তুজা
শিক্ষক