স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে গিয়ে আমরা সেই পুরনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির তাণ্ডব। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতির পিতার ছবি, ভাস্কর্য ভাঙচুর করতে দেখলাম, আগুন জ্বালাতে দেখলাম, হাইওয়ে ফাঁড়িসহ থানা আক্রমণের দৃশ্যপট চোখে পড়ল। তার সাথে ব্যাপকভাবে যে বিষয়টিকে মূল টার্গেট হিসেবে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেখলাম, ঘুরেফিরে তা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ওপর খুব জোরেশোরে কশাঘাত করা। বিষয়টি নতুন নয় তবে এবারের দৃশ্যমান মানসপটের বৈচিত্র্য খুব পরিষ্কারভাবে দেখা দিল। তা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে বাঙালি সংস্কৃতির যে সকল শিকড় গ্রথিত রয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রকে বেছে নিয়ে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তানি ভাবধারার মানসপটরা, পুনরায় একটি প্রশ্নের অবতারণা করছে, ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের নামে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে? ঘুরেফিরে বাংলাদেশে নতুন করে পাকিস্তানি ভাবধারাকেই ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে কিনা? তারা কেন বাঙলা সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়? সে কারণে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, প্রেস ক্লাব, গণগ্রন্থাগার, এমনকি শিক্ষা বা বুদ্ধির চর্চার সাথে সম্পর্কিত যে সকল কেন্দ্র রয়েছে, সে জায়গাগুলোতে সফল আঘাত হানতে বেশ ভালো করেই সক্ষমতা দেখিয়েছে তারা। বাংলাদেশ পুলিশও তাদের তার্গেট। জানমাল ও নাগরিক নিরাপত্তা বিনষ্ট করতে পারলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে এই হেতু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ এর ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ সপ্তাহের ভাষণে তাঁর যথার্থ স্বীকৃতি দেন এই বলে- ‘আজ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। যতদিন বাংলার স্বাধীনতা থাকবে, যতদিন বাংলার মানুষ থাকবে, ততদিন এই রাজারবাগের ইতিহাস লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।’ কাজেই বাংলাদেশ পুলিশও সে কারণেই তাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ বছর হলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, তাদের নিজেদের ভাষায় এখনো ধর্মচর্চা করার মতো জ্ঞান-গরিমায় দীক্ষিত হতে পারেনি। এই সকল তথাকথিত ধর্মদখলি মানুষেরা শুরু থেকেই কুটকৌশল প্রয়োগ করে আসছে খুব চতুরতার সাথে। নিজ ভাষায় ধর্মচর্চা করার সুযোগ থাকলে, ধর্মের মূল বিষয়বস্তুগুলোকে যত সহজে অনুধাবন, অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পারা যায়, সেই জায়গাটি রাখা হয়নি। বাংলাদেশের এই শ্রেণির মানুষ তারা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি বা গোত্র বড় করার প্রয়োজনে এবং ব্যবসায়িকভাবে অর্থ বৃত্তের একটি বাজার তৈরি করার মানসিকতায়, তারা এই পন্থাকে সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের আয়ত্তে রেখেছেন। কারণ, ধর্ম শেখানোর উপযুক্ত ইজারাদার একমাত্র তারা; এমন ধারণা সামাজিক মনস্তত্ত্বে খুব সুকৌশলে প্রতিষ্ঠা করে সমাজকে ধর্মান্ধ ও বিকলাঙ্গ করার প্রক্রিয়াটিতেও ইতোমধ্যে অনেক পথ হেঁটে ফেলেছেন তারা। কাজেই ভালো-মন্দ সকল ক্ষেত্রেই ভারত বিরোধিতা, তাদের ধর্মের অংশবিশেষ হিসেবে রক্ত মাংসে মিশে থাকার সুবাদে, নির্বিচারে সকলকেই তারা এ শিক্ষা প্রদানে অনেক বেশি সফলও হয়েছে। বাঙালির ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে, সর্বসাধারণের ঘরে এ শিক্ষা তারা দিয়ে আসছে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে। স্মরণীয় যে, বাংলাদেশ জন্মের প্রাক্কালে এবং আরেকটু পেছনে ফিরে গেলে, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এদেশের একটি বিশেষ গোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে যেমন করে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে অনাগ্রহ দেখিয়ে পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের ভাষাযুদ্ধে বৈরিতা করেছে, তেমনি করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জন্মের প্রাক্কালে পাকিস্তানিদের সাথে এদেশের একাংশ মানুষ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন, একই আত্মায় একীভূত করতে পেরেছিলেন। তাই যার যা যা করণীয় তার সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে বাঙালির মধ্যে যে শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই শক্তির সাথে হাজার বছরের বাঙালি-সংস্কৃতির যে প্রচণ্ড শক্তি, একীভূত হয়ে প্রেরণা জুগিয়ে বাঙালি যোদ্ধাদের মধ্যে যে প্রাণের গতিশক্তি সঞ্চার করেছিল, সেই শক্তির কাছে বিশ্বের আলোচিত রেজিমেন্টাল পাকিস্তানি সামরিক শক্তি পরাজয় বরণ করে। ১৯৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা, পরবর্তীকালে ইতিহাস বিকৃতি করে ক্ষমতা গ্রহণ, বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে ব্যবহার করে মন্ত্রিত্ব লাভ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে হত্যাচেষ্টা, সারাদেশে একসাথে বোমাবাজি, রমনার বটমূলে বোমা বাজি করে মানুষ মেরে ফেলা, জ্বালাও-পোড়াও করা, সিনেমা হলগুলোতে বোমাবাজি করে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা তথা বাঙালি সংস্কৃতিকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে মুছে দেয়ার সংকল্প বাস্তবায়ন করতে দেখেছি স্বাধীনতাবিরোধী, বাঙলা সংস্কৃতিবিরোধী, চিহ্নিত এই গোষ্ঠীকে।
তাছাড়াও রেললাইন উপড়ে ফেলা, রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে মানুষ মেরে ফেলা এমনকি ৫ মে হেফাজতের মতিঝিল তাণ্ডব, ২০১৩-১৪-তে জ্বালাও-পোড়াওয়ের বীভৎসতা আর সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, আবক্ষ ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, ছবি পুড়িয়ে দেওয়া, তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করেছে। তারা এদেশের সকল সুবিধা ভোগ করলেও তারা কেউ বাঙালি সংস্কৃতিতে যেমন বিশ্বাস করেন না, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বা এদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি হিসাবে তারা মানেন না। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক দর্শন সকল জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণের সহঅবস্থান নীতিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তাদের কাছে শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, অপছন্দেরও বটে। সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবেই এদের আত্মপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের শোক তারা আজো কাটিয়ে উঠতে না পেরে বরং দিনে দিনে বিভিন্নভাবে ক্ষমতাশ্রয়ী হয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করছে। বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিনির্ভর দেশজ ঘরানার নিজস্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার বলেই তাদের পৈশাচিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে আনন্দ প্রদর্শন করতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু ও এদেশের সংস্কৃতির ওপর বারবার আঘাত হানার মাধ্যমে।
স্বদেশী ভাবধারায় প্রচলিত শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বকীয়তার চর্চা প্রগতিশীল কল্যাণমুখী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি সুযোগ পেলেই আক্রমণের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন বাংলা সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানসমূহ আর বঙ্গবন্ধুর ছবি, ভাস্কর্য। শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-গরিমায় আরব সমাজ যখন পিছিয়ে তখন আরবে জন্মেছিলেন বিশ্বমানব হজরত মোহাম্মদ। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আরবে তখন আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ চলছিল। অর্থাৎ সে সময় সভ্যতার আলো ছিল না বললেই চলে। তখনকার মানুষের আচরণে বর্বরতার চরম সীমা প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। বিশেষ করে মক্কা নগরীর তখনকার মানুষের অমানবিক আচরণ ইতিহাসের পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে। শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমার উপলব্ধিতে তিনি বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাওয়ার কথা বলেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে অনেকেই সেই শান্তির ধর্মকে আশ্রয় করে এমন কিছু ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করালেন কখনো কখনো বর্বরতাকেও তা হার মানাচ্ছে। এরা দেশের মা, মাটি, মানুষকে বিশ্বাস করে না, এরা বিভিন্ন গানের সুর রপ্ত করে বিভিন্ন বয়ানে ব্যবহার করলেও বাংলা সংস্কৃতিতে তাদের বিচরণ নেই বললেই চলে। বাংলা আর বাঙালি শব্দ দুটোই তাদের কাছে খুব অপছন্দের, দারুণ অনীহা প্রদর্শিত হয় তাদের কথাবার্তা আচার-আচরণে। এদেশের বাঙালির জীবনযাত্রার স্টাইল, ফ্যাশন, বিদ্যাচর্চা, কবিতা, নাটক, গান সবকিছুতেই তাদের অপছন্দ, অনীহা এমনকি এগুলোকে স্তব্ধ করতে, রুখে দিতে হেন কোনো কাজ নেই যা তারা করে না।
যুগের সভ্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের শুধু বর্বর বলা যথেষ্ট হবে না বরং তাদেরকে চরমপন্থী, উগ্রবাদী ‘বাংলাবিরোধী অবাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করাটাই অধিকতর সমীচীন বলে মনে করি। সেই সাথে বিস্মিত হই মনের অভ্যন্তরে লুক্বায়িত মিথ্যাচারে আবৃত্ত হয়ে প্রকাশভঙ্গিতে যখন বলে থাকেন তারা অরাজনৈতিক কিন্তু কর্মকাণ্ডের সবটুকুতেই অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতালিপ্সুতা উভয়ই স্পস্টত বেশ চোখে পড়ে। বাঙালি সংস্কৃতিকে তারা বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার প্রসারে মরিয়া। অবশ্য এটি তাদের সমমনা অগ্রজ পাকিস্তানিদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কেননা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বঙ্গবন্ধুকে রোহিত করতে গিয়ে যখন শুধু জেল-জুলুমের অত্যাচার যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সাথে কূটকৌশলে তদানীন্তন পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা রবীন্দ্রসাহিত্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তখনো ধোয়া উঠেছিল এ জাতীয় সাহিত্য ভারতীয় সংস্কৃতি লালন করে। অথচ কদিন আগেও যারা সর্বভারতীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই পরিচয় বহন করে এসেছে। আমাদের দেশের এই গোত্রীয় মানুষের চেতনা ঠিক একই পথ অনুসরণ করে আসছে এবং এখনো তা করছে যখন দেখি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলা সংস্কৃতির প্রাণভ্রমরা জাতীয় সংগীতকে নিয়ে নানা রকম কটাক্ষ উচ্চারণ করে থাকেন।
অবাধ সংস্কৃতিচর্চার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে যেতে হবে। সংস্কৃতিভিত্তিক পৃথক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও তা সঠিকভাবে বিকশিত করার বাস্তবমুখী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে সংকুচিত করার পরিবর্তে তা প্রসারিত করার দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানানো জরুরি। ক্ষেত্রবিশেষে ঝুঁকি মোকাবিলা করার বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণও করতে হবে। পাড়া-মহল্লায় আগের মতো ছোট আকারের অনুষ্ঠানের আয়োজন বাড়াতে হবে। বাঙলা সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় প্রশাসনিক অনুমতির বিষয়টা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহযোগিতা অনুভব করলে সেক্ষেত্রে বিষয়টা বিবেচনায় নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে অন্যথায় বাংলাদেশে বাস করে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার জন্য পৃথক অনুমতি নিতে হবে, তা কেন! বরং তা বেমানান, এমনকি সংস্কৃতি বিরুদ্ধচারীদের চাওয়াটা না চাইতেই পূরণ করে দেওয়াও হয় এই নীতির মাধ্যমে। এই অবস্থা চলতে থাকলে যা দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ কিছু ঘটলে অবাক কিংবা বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। সাংস্কৃতিক জাগরণ সমাজে দৃশ্যমান করা আশু প্রয়োজন। অসাম্প্রদায়িক প্রসারতাই কেবল পারে সাম্প্রদায়িক পশুত্বকে দমন করতে।
লেখক : পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব