মুক্তমত

সম্ভাবনাময় কৃষির সমস্যা ও প্রতিকার প্রসঙ্গে

  • প্রকাশিত ১২ জুলাই, ২০২১

মো. জাফর আলী

 

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে এ দেশকে বিভিন্ন খাতের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। দেশের এই খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো কৃষি। ২০১৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান হলো ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিই উর্বর এবং ব্যবহারযোগ্য। কারণ এখানে কোনো সোনার খনি না থাকলেও প্রতিটি জায়গাতেই যেন শস্য নামের সোনার ফলন হয়ে থাকে। এজন্যই হয়তো সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা কৃষিপ্রধান এ দেশের মাটিকে সোনার চাইতেও খাঁটি বলা হয়।

প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল কৃষিকাজের জন্য বিখ্যাত এবং একটি সম্ভাবনাময় এলাকা। একসময় এদেশে প্রচুর আবাদি জমি ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ আবাদি জমির পরিমাণ কমতে থাকে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা এবং আধুনিক বিশ্ব ও পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়তই দেখা দিচ্ছে। এভাবে যদিও কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, তারপরও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে, সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা ও প্রচেষ্টা এবং গণমানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিকূল আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও এ দেশে কৃষি দ্রব্যাদি উৎপাদনে বর্তমানে একটি ভারসাম্য অবস্থা বিরাজমান। ফলে বেশ কিছুদিন যাবৎ অর্থকরী বিভিন্ন ফসল বা শস্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রায়ই বিশ্বের সেরা দশে অবস্থান করছে, যেটি আমাদের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক।

সামগ্রিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের কৃষি খাতে ইতিবাচক ও অপার সম্ভাবনা থাকলেও এতে বিদ্যমান রয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা। বাংলাদেশের কৃষির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিকূল আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়-তুফান, নদীভাঙন ও ভূমিধসসহ বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন আমাদের কৃষি। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে জনসংখ্যা ও বসতবাড়ি বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বিশ্বে কৃষি উপকরণসমূহের ব্যাপক আধুনিকায়ন হলেও, অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়াতে এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এগুলোর সহজলভ্যতা এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। গ্রাম পর্যায়ের অনেক কৃষকই পুরনো বা সনাতন পদ্ধতিতে, দেশীয় যন্ত্রপাতি এবং কায়িক শ্রমের ওপর ভিত্তি করে ফসল ফলিয়ে থাকেন। তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই উপযুক্ত দিক নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। একটা বিষয় না বললেই নয় যে, কৃষক কষ্ট করে ও বহু টাকার জোগান দিয়ে চাষাবাদ করে যখন বিক্রি করতে যায়, তখন অধিকাংশ সময়ই আশানুরূপ বাজারমূল্য পায় না। অনেক সময় তাদের ঘাটতির সম্মুখীনও হতে হয়। এক্ষেত্রে খুচরা বিক্রেতা ও মজুতদারি একটি চক্র সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। নির্দিষ্ট কিছু পণ্য সরকার ভর্তুকি দিয়ে ক্রয় করলেও অধিকাংশ পণ্যেই কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পায় না। আবার অনেক সময় কৃষকের হাতে নিজস্ব বা দেশি পণ্য থাকা সত্ত্বেও আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করায় দেশি পণ্যের বাজারমূল্য কমে যায়। আর সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকার কারণে অনেক সময় পেঁয়াজ-রসুন, আলু, ভুট্টা ও গমের মতো বহু শস্যই নষ্ট হয়ে যায়। আবার বাংলাদেশের বহু এলাকা রয়েছে যেখানে কৃষক চাষাবাদ করতে সক্ষম কিন্তু শস্য বা পণ্য বিক্রির বাজার দূরবর্তী হওয়াতে বা যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা থাকায় সেই এলাকায়ও কৃষি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ মাশরুমের কথা বলা যেতে পারে। চরম বাস্তবতা হলো, এটি যেখানে-সেখানে বিক্রি করা যায় না। আবার বিক্রি করা গেলেও উপযুক্ত পরিমাণে বাজারমূল্য উদ্যোক্তা বা কৃষকরা পায় না। এরকম বহু সমস্যার কারণে মূলত কৃষকরা বা কৃষি উদ্যোক্তারা দিনদিন কৃষিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, প্লাস্টিক ও পলিথিন ইত্যাদির যত্রতত্র উপস্থিতিতে মাটি দূষণ ঘটছে। আবার বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে উপকারী অণুজীবসমূহ ধ্বংস হয়ে দিনদিন মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষি কার্যক্রম ক্রমেই হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার কৃষি ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন সাধনে বিভিন্ন ধরনের কার্যকরী ও প্রশংসাজনক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং তাদের নিজস্ব কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন দেশের সর্বত্র ও সমভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী হচ্ছে কি না তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।

তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান, পরামর্শ ও কৃষি সম্পর্কিত সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে সবচেয়ে নিকটতম সেবাদানকারী ব্যক্তি হলেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ। এক তথ্যমতে জানা গেছে, কোনো কোনো উপজেলায় কয়েকটি ব্লক মাত্র একজন উপসহকারী কর্মকর্তা দিয়ে চালানো হচ্ছে। এই পদে সারা দেশে বহু আসন খালি থাকা সত্ত্বেও নিয়োগে জটিলতা দেখা যচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ওই পদে ১৬৫০ জনকে সুপারিশ করার পর, দেড় বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এরকম ভাবে মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তার ঘাটতি থাকার কারণে কৃষক এবং এসব কর্মকর্তার মধ্যকার দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কৃষি সেবা অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এই কৃষি। ফলে এ খাতের সব সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ দ্রুত নিরূপণ করা বাঞ্ছনীয় এবং সে মোতাবকে এর সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষিতে আমরা বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আর তাই বাড়ির আঙিনা, ছাদ, বারান্দা, পতিত জমি ও পরিত্যক্ত ঘরগুলোতে গাছগাছালি, মৎস্য, হাঁস-মুরগি, কবুতর ও গরু-ছাগলসহ লালনপালনসহ বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালি ও শস্য আবাদের মাধ্যমে কৃষিতে যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে আমরা সক্ষম। বেসরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যে অনেকেই এ জাতীয় কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এ কারণে বর্তমানে দেশ কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এখন প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি—সব পর্যায় থেকে এর পরিকল্পনামাফিক সহযোগিতা। আশা করি ২০৪১ সালে সরকারের উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্যে সবাই এক্ষেত্রে মনোযোগী হবেন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads