বিশাল সাহা
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। ছোটবেলা থেকে সবাই এই প্রবাদটি জানি। বহুল প্রচলিত এই প্রবাদে স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু আদতে স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক স্বাস্থ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের বালাই নেই। অথচ শারীরিক স্বাস্থ্য আর মানসিক স্বাস্থ্য একে অন্যের পরিপূরক। শারীরিক স্বাস্থ্য শব্দটির সঙ্গে বেশ আগে থেকে সকলের পরিচয় থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ইদানীং সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানসিক অসুস্থতা। মানসিক অসুস্থতার কারণসমূহের মধ্যে আছে হীনম্মন্যতা, হতাশা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, সাধ্যের চেয়েও অধিক প্রত্যাশা, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি।
বর্তমান করোনাকালীন সময়ে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত সমাজ। দেশে করোনার প্রকোপ শুরুর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রায় দেড় বছর হয়ে আসছে ঘরবন্দি শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পেরে ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে শুরু করে ঘরবন্দি থাকার দরুণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে অনেকে। কেউ কেউ ডুবে গেছে হতাশায়। এমনকি অনেকে পারিবারিক অশান্তির কারণেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে দিনদিন। বিশেষ করে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা যুবক-যুবতীরা এবং যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষের দিকে, কিন্তু করোনার জন্য চাকরির পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারছে না, তারা আছে চরম মানসিক অশান্তিতে। করোনার দরুন ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে না পারায় সরকার তাদের অটোপাস দিয়ে দেয়। কিন্তু এরপরও উচ্চশিক্ষার জন্য কোথাও ভর্তি হতে না পেরে চরম মানসিক বিপর্যয়ে সময় অতিবাহিত হচ্ছে তাদের। এই অবস্থা বিরাজ করছে ২০২১ সালের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও। স্মাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আছে চরম দুশ্চিন্তায়। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বড় ধরনের সেশনজটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে তারা। এ কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আছে। মানসিক অসুস্থতার আরেক কারণ দারিদ্র্য। করোনার কারণে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত অনেকের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনযাপন করার চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন অনেকেই। অনেকে এই কষ্ট লাঘবের জন্য বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য কাজ।
শারীরিক রোগের যেমন চিকিৎসা করা হয়, মানসিক রোগেরও তেমন চিকিৎসা আছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশের ১৭ শতাংশ মানুষের কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা রয়েছে। মানসিক অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য দেশে দুটি সরকারি মানসিক হাসপাতাল আছে—একটা ঢাকায় এবং অন্যটি পাবনায়। কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত এই দুই সরকারি মানসিক হাসপাতাল। ডাক্তার সংখ্যা কম, আবাসন ব্যবস্থার বেহাল দশা, খাবার নিম্নমানের থেকে শুরু করে হাজারো সমস্যা। বেসরকারি খাতের অবস্থা আরো শোচনীয়। নিয়ম-নীতির বেড়াজাল ভেঙে অনিয়মে চলছে তাদের অবাধ কার্যক্রম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকাতেই সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র ১৫টি। বেসরকারি এই হাসপাতালগুলোর অনেকেরই নেই লাইসেন্স। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, শয্যা। অনিয়মের দোলনায় দুলছে এই নামমাত্র মানসিক চিকিৎসালয়গুলো। এমনকি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ পর্যন্ত নেই এসব বেসরকারি চিকিৎসালয়গুলোর।
২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯ অনুযায়ী, দেশের দুই কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসেবে তা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ইনস্টিটিউটের হিসাবে, দেশের সাড়ে ১৬ কোটির বেশি মানুষের জন্য এই মুহূর্তে মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন ২৭০ জন। আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০ জন, যা অতি নগণ্য। হিসাব করলে দাঁড়ায় কোটিতে মাত্র ১৫ জন মানসিক চিকিৎসক আছেন। আর পর্যাপ্ত জনবল না থাকার সুযোগই নিচ্ছে এসব বেসরকারি চিকিৎসালয়গুলো।
বর্তমানে মানসিক চিকিৎসা আর মাদকাসক্তদের চিকিৎসাকে একই কাতারে ফেলে চিকিৎসা করা হচ্ছে, যার পুরোটাই অনিয়ম। কিছু মাদকাসক্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত হলেও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সাধারণ মানসিক রোগির পার্থক্য আছে। তবে মানসিক চিকিৎসা কিংবা মাদকাসক্তের চিকিৎসা—যাই হোক না কেন, মূলত বেসরকারি চিকিৎসালয় কিংবা রিহ্যাবগুলোয় চিকিৎসার নামে অমানবিক মারধর করা হয় রোগীকে, যা চিকিৎসার পরিপন্থী। অনেক বেসরকারি মানসিক চিকিৎসালয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়ে এসব চিকিৎসালয় চালিয়ে আসছে। শুধু সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে এসব অনিয়ম অবাধে চলছে। তবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ঢাকার ১০টি বেসরকারি মানসিক চিকিৎসালয় তদারকি করে র্যাব জরিমানা ও আটক করেছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা একটা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত দশ মাসে কোভিড-১৯-এ মারা গেছে ৫ হাজার ২০০ জন মানুষ। আর সেখানে আত্মহত্যায় মারা গেছে প্রায় ১১ হাজার মানুষ। সংখ্যায় যা কোভিডে মৃত্যুর থেকে দ্বিগুণ। এসব আত্মহত্যার অধিকাংশই হতাশা থেকে। এই হতাশাও এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অবধারিত। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে নিয়মমাফিক চলতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার কমিয়ে দিতে হবে, নিজেকে তথা পরিবারে সময় দিতে হবে, নেতিবাচক চিন্তা দূর করতে হবে এবং সৃজনশীল কাজে আত্মনিয়োগ জরুরি। মোদ্দা কথা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এ সম্পর্কে আমরা সচেতন নেই। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সরকারি, বেসরকারিভাবে এবং গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। মানসিক চিকিৎসার মান উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যুগের দাবি।
এক্ষেত্রে মানসিক রোগীদের চিকিৎসার নামে নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। মানসিক চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক চিকিৎসার মান নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত তথ্য, বুলেটিন প্রকাশ করতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে, মানসিকভাবে সুস্থ থাকার বিকল্প নেই। মানসিক সুস্থতা শারীরিক সুস্থতা প্রদান করে। তাই নিজে মানসিকভাবে সুস্থ থেকে অন্যকে সচেতন করতে হবে।
শিক্ষার্থী : প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা