মাওলানা রফিকুল ইসলাম মন্ডল
ইনসাফ আরবি শব্দ। অর্থ ন্যায়বিচার বা সুবিচার। ইনসাফ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ছাড়া বিশ্ব চরাচরে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে শান্তি, নিরাপত্তা, মানবতা, মানবিকতা, ভারসাম্যতা কোনো কিছুই সম্ভব নয়। ইনসাফ না থাকার দরুন পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বত্রই অশান্তি ও হতাশা বিরাজ করছে। অন্যায়-অনাচার, অত্যাচার-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন দুর্নীতি ইত্যাদি সমাজবিধ্বংসী কার্যকলাপে সমাজজীবন কলুষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তা ছাড়া ইনসাফ না থাকার কারণে মানব চরিত্রের অন্যতম অলংকার ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এ ধরনের সুষমামণ্ডিত গুণাবলি সমাজ জীবন থেকে ক্রমশ বিদায় নিচ্ছে।
ইনসাফ বা ন্যায়বিচার সম্পর্কে আল্লাহ পাক কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আমি আমার রাসুলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি। তাদের সাথে কিতাব ও ন্যায়নীতির মিজান অবতীর্ণ করেছি। যাতে মানুষ ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাজিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচণ্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত ২৫)। এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পয়গম্বর ও আসমানি কিতাব প্রেরণের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে ন্যায় ইনসাফ ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। ন্যায়-নীতি, শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম করা। এরপর আয়াতে লৌহ সৃষ্টির কথাও বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লৌহ সৃষ্টির অন্যতম লক্ষ হলো ইনসাফ তথা ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। নসিহত ও তালিম তারবিয়াতের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের পথে সবাইকে আনা যাবে না। আবার তাদের যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে পৃথিবীতে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা মোটেই সম্ভব হবে না। তাই তাদের সঠিক পথে ফেরানোর জন্য এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে লৌহের আইনানুগ ব্যবহার করতে হবে।
আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আর পৃথিবী ন্যায় ইনসাফের মাধ্যমেই কায়েম থাকতে পারে। অন্যথায় পৃথিবী অনর্থক হবে। যেসব কারণে সমাজে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তা চিহ্নিত করে তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য কোরআনুল কারিমে জোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাক এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর। এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।’ (সুরা মায়েদা-৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর। যদি তা তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটতম আত্ময়স্বজনের বিরুদ্ধেও হয়, যদি সে ব্যক্তি ধনী কিংবা গরিবও হয়।’ (সুরা নিসা ১৩০)। সাধারণত মানুষ দুটি কারণে ন্যায়ের ওপর কায়েম থাকতে পারে না। অন্যায়ের শিকার হয়ে যায়। সে দুটি হলো- ১. নিজের অথবা বন্ধু-বান্ধব ও আত্ময়স্বজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। ২. কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা ও মনোমালিন্য।
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম ইনসাফ বা ন্যায়বিচারকে অত্যান্ত ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। আত্ময়-অনাত্মীয়, উঁচু-নিচুু শত্রু-মিত্র, মুসলিম-অমুসলিম, আস্তিক-নাস্তিক সকলেই সমান বিচার পাওয়ার অধিকারী। কারণ ইসলামের ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। একদা এক মুসলিম ও ইহুদির মধ্যে জমির পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া হয়। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম ব্যক্তিকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের ওপর জুলুম করে তাহলে কিয়ামতের দিন আমি ঐ অমুসলিমের পক্ষে ওকালতি করব। এমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ন্যায়নীতির নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ইসলামী খবর ডেস্ক