যে দিকে চোখ যায় শুধু লালচে বালিময় প্রান্তর। নীল আকাশ আর গনগনে ভূমি আচমকা মিশে গেছে দিগন্ত রেখা ছাড়াই। দূরে অপলক তাকিয়ে থাকলে ভ্রম হয়। পিসাসায় ছাতি ফাটে। গরম বালির বুকচিরে পথটি যে কতদূর গেছে তা ভাবনায়ও আসে না। তবে ৯২ লাখ বর্গকিলোমিটারের সাহারা মরুভূমি কখনো কখনো পরম মমতায় ছায়া দেয়, দেয় পিপাসা মেটানোর সুপেয় পানিও। কোনো কাফেলার ভাগ্য ভালো হলে কয়েকশ কিলোমিটার পর পর দেখা মেলে একটা ছোট অথবা বড় মরূদ্যানের। প্রকৃতির খেয়ালেই সৃষ্টি মরূদ্যানগুলো মরীচিকার পিছে ছুটে চলা শত শত কাফেলাকে ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার রসদ দিয়েছে, বাঁচিয়েছে হাজারো প্রাণ। তবে এবার মানুষের প্রচেষ্টা স্বপ্ন দেখাচ্ছে মরুভূমিটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে মরূদ্যান বানানোর। গবেষকরা বলেছেন, বায়ুকল আর সৌরকোষের কল্যাণে আবার সবুজ হয়ে উঠবে সাহারার লালচে পোড়া বালুকাপ্রান্তর। ঋতুচক্রের মতো নিয়ম করে সেখানেও নামবে বৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উষ্ণায়নের প্রভাবে যখন পুরো পৃথিবীই তপ্ত উনুনের পিঠের মতো হয়ে উঠছে, দাবানল-নির্বিচার বন উজাড় আর নদীর গতিপথ বদলের কারণে মরুকরণের কবলে পড়ছে বিশাল বিশাল এলাকা তখন হাজার বছরের উষর প্রান্তরে ‘কল্পিত সবুজের রেখা’ মেঘলা আকাশের ‘রুপালি রেখা’র মতো আশা জাগায়।
গবেষকরদের দাবি, পৃথিবীর বৃহত্তম এই মরুভূমিটির দক্ষিণের সাহেলের জনমানবহীন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বড় বড় কিছু বায়ুকল ও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র বসালে সেখানেও দেখা মিলবে সবুজের, নিয়ম করে নামবে বৃষ্টি। গত সাত সেপ্টেম্বর সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে মানব সভ্যতার জন্য পরম আশা জাগানিয়া এই সংক্রান্ত গবেষণাটির নিবন্ধ। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়লে সবুজায়ন ও চাষাবাদও বাড়বে। গবেষণাটির গুরুত্বপূর্ণ একজন গবেষক ও ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক ইয়ান লি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, বায়ুকল এবং সৌরকোষ যেকোনো এলাকার তাপ ও আর্দ্রতা বাড়াতে পারে সে কথা আগেরই জানা। তবে প্রথমবারের মতো তারা এমন একটি মডেল দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন যা সাহারা মরুভূমির সাহেল অঞ্চলে বৃষ্টি নামাতে ও সেই অঞ্চলকে সবুজ করতে সহায়তা করবে। লি জানান, আগের অনেক গবেষণা ও মডেলে দেখা গেছে বৃহৎ আকারের বায়ুকল ও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র মহাদেশীয় পরিসরের জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর সে পরিবর্তনটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে সবুজায়নটা ঠিকঠাক না হলে মডেলগুলো অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করবে। এই ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখেই লি এবং তার সহ-গবেষকরা কৃত্রিম উদ্দীপনার মাধ্যমে মডেলটি দাঁড় করিয়েছেন।
তারা দেখেছেন, সাহারা মরুভূমির ৯০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা বড় বড় বায়ুকল এবং সৌরকোষ দিয়ে ঢেকে ফেলতে পারলে বায়ুকলগুলো থেকে ৩ টেরাওয়াট ও সৌরকোষগুলো থেকে ৭৯ টেরাওয়াট বিদ্যুৎ আসতে পারে প্রতিবছর যা পৃথিবীর বিদ্যুতের মোট চাহিদার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। লি বলেন, এই শক্তি বিপুল শক্তি। ২০১৭ সালে যেখানে সারা বিশ্বের বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৮ টেরাওয়াট সেখানে সাহারা মরুভূমি থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ বিশ্ব চাহিদার কয়েকগুণ বেশি। উল্লেখ্য, এক টেরাওয়াট বিদ্যুতে এক হাজার কোটি ১০০ ওয়াটের বাল্ব একসঙ্গে জ্বলতে পারে। ইয়ান লিদের তৈরি এই মডেলে আর দেখা গেছে কোনো এলাকায় বায়ুকল থাকলে সেখানকার বায়ু কীভাবে উষ্ণ হয়। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বায়ুকল উল্লম্বভাবে ওপর-নিচের বাতাস মিশে নিচের বায়ুকে উষ্ণ করে। আর এই ঘটনা বায়ুকল এলাকায় প্রতি এক দিনে দশমিক ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, এর আগে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাগুলোয় এই ঘটনার ফলে যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে নতুন মডেলে তার চেয়ে দ্বিগুণ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করা বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে নিদেনপক্ষে সাহেল অঞ্চলে বায়ুকল স্থাপনের মাধ্যমে প্রতি দিন এক দশমিক ১২ মিলিমিটার অতিরিক্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যায়। আর এক বছরে সে পরিমাণ হবে ২০০ থেকে ৫০০ মিলিমিটার, যা ওই অঞ্চলকে মরুভূমির ‘অভিশপ্ত’ সংজ্ঞার বাইরে নিয়ে যাবে, ওই এলাকার সবুজায়নে রাখবে বিশেষ ভূমিকা, সম্ভব হবে চাষাবাদও। (সাধারণত কোনো এলাকায় বছরে গড়ে ২৫০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হলে সেই অঞ্চলকে মরুভূমি বলা হয়।)
সাহারাকে সবুজায়নের যে নতুন মডেল দাঁড় করানো হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে, কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণে সৌরকোষেরও বিশেষ ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে গবেষণাটির আরেক গবেষক ইগেনিয়া কালনয় বলেন, সাহেল অঞ্চলে পরিকল্পনামতো সোলার ও উইন্ড ফার্ম কাজ শুরু করলে সেখানে বৃষ্টিপাত বাড়বে যা ওই অঞ্চলের গাছপালা বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের বিশিষ্ট এই অধ্যাপক বলেন, সোলার প্যানেল আর ইউন্ড মিল বসালে সেখানে ভূমি ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া হবে তা বৃষ্টিপাত বাড়াতে সহায়তা করবে। এই দুটি স্থাপন করলে ভূমি-পৃষ্ঠকে ছায়াযুক্ত ও অচ্ছুত করবে, যার ফলে সেই এলাকা উদ্ভিদ ফলানোর সক্ষমতা অর্জন করবে।
এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক বিজ্ঞানী সাফা মোতেসহারী বলেন, ইয়ান লিদের এই মডেল কখনো যদি বাস্তবায়ন হয় তবে ওই এলাকায় বৃষ্টিপাত ও সবুজায়ন ছাড়াও সেখানে গড়ে উঠতে পারে মানুষের নতুন সভ্যতা। মরুভূমিটির সংশ্লিষ্ট অনেক দেশের কৃষি, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে আসতে পারে নতুন যুগ।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক রাস ডিকারসন এই গবেষণা বা মডেল প্রণয়নে যুক্ত না থাকলেও এই সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তার ভাষায়, গত কয়েক দশক থেকে যখন সাহারা তার আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারিত হচ্ছে সেখানে নতুন মডেলটি দারুণ আশা জাগানিয়া। বায়ুকল আর সৌরকোষের সহায়তায় আগ্রাসী সহারাকে রুখে দেওয়ার পাশাপাশি তাকে সবুজ আর শক্তির আধার হিসেবে দেখানো হচ্ছে। যদিও সমগ্র পরিকল্পনা, মডেল ও বাস্তবায়নকে উইন-উইন অবস্থায় দেখছেন অধ্যাপক ডিকারসন।