প্রায় তিন যুগের আন্দোলনেও নিয়োগপত্র পায়নি দেশের পরিবহন শ্রমিকরা। বর্তমানে এ খাতে কর্মরত ৭০ লাখ শ্রমিক চরম অনিশ্চয়তা নিয়েই প্রতিনিয়ত কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করছেন। কখনো কখনো টানা ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টাও কর্মরত থাকতে হচ্ছে তাদের। তবে এই অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য বাড়তি কোনো মজুরি পাচ্ছেন না তারা। এক্ষেত্রে ‘ক্ষমতাধর’ পরিবহন মালিকদের কাছে সরকারও যেন অসহায়।
দিনের পর দিন এভাবে বাড়তি পরিশ্রম করায় অনেক পরিবহন শ্রমিক অধৈর্য হয়ে পড়েন; যাত্রীদের সঙ্গে করেন খারাপ ব্যবহারও। অনেক সময় তারা বেপরোয়াগতিতে গাড়ি চালায়, মেতে ওঠে রেষারেষিতেও। আবার অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘটে ভয়ানক সব দুর্ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেন, আমাদের পরিবহন শ্রমিকরা কেউ বেতনভুক না। সবাই ‘ট্রিপভিত্তিক’ চুক্তিতে কাজ করে, চাকরি না। যে কারণে অতিরিক্ত কাজের জন্য কোনো টাকা পায় না। আওয়ামী লীগপন্থি সংগঠন সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী বলেন, ব্রিটেন, জাপান, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও পরিবহন শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয় না। আর পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, নিয়োগপত্র না থাকার কারণে এখানে ‘চাকরির’ নিশ্চয়তা নেই। শ্রমিকরা সরকারি কল্যাণ তহবিলের টাকাও তুলতে পারছেন না।
শ্রমিক নেতারা জানান, বাস-মিনিবাস, ট্রাক, লরি, কভার্ড ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা লেগুনার শ্রমিকরা বর্তমানে দুর্ঘটনায় বা অসুস্থতায় শুধু ইউনিয়নগুলোর নিজস্ব কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য পান। ২০১৩ সালে গঠিত সরকারি শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে দুর্ঘটনায় আহত-নিহত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্য, বার্ষিক চিকিৎসা ভাতার মতো বহু সুবিধা পাওয়ার কথা। চালকদের পাঁচ বছর মেয়াদি লাইসেন্স নবায়নের সময় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এই তহবিলের জন্য ২০ শতাংশ হারে ২২০ টাকা কেটে রাখে। আর মালিকদের প্রতিবছর আড়াই শতাংশ হারে অর্থাৎ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি এক লাখ টাকা হলে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়।
নগর ও দূরপাল্লার পরিবহন শ্রমিকরা জানান, মালিকদের কৃপণ মনোভাব, সড়কের দুরবস্থা এবং সড়ক-মহাসড়ক ও ফেরিঘাটের যানজটের কারণে তাদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী মো. বশির আট বছর ধরে নগরীতে মিনিবাস চালাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গড়ে ১৮ ঘণ্টা গাড়ি চালাতেই হয়। কখনো কখনো ২৪-২৫ ঘণ্টাও থাকতে হয় স্টিয়ারিং-এ। আরো কয়েকজন চালকের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, খুব বেশি বিশ্রাম না নিলেও নগর পরিবহনের কোনো রুটের বাস-মিনিবাস চালকের পক্ষে দৈনিক দেড় হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব না। তাদের গড় আয় ১ হাজার ২০০ টাকা। আর সহকারীদের ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা।
বাগেরহাটের চিতলমারীর ৪৫ বছর বয়সী মো. জাকির হোসেন ১৭-১৮ বছর ধরে দূরপাল্লার বাস চালান। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, যাওয়া-আসা এক ট্রিপ- এভাবে পারিশ্রমিক হিসাব করা হয়। ফেরিঘাটের যানজটে এক ট্রিপ শেষ করতে অনেক সময় ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টাও লাগে। ঢাকা-গোপালগঞ্জ রুটের এই চালক প্রতি ট্রিপে পান ৯০০ টাকা। তার সহকারী (হেলপার) পান ৫০০ টাকা ও সুপারভাইজর ৪০০ টাকা। চালক-সহকারীরা জানান, দূরপাল্লার শ্রমিকরা মাসে ১৪ দিনের বেশি ডিউটি পান না। অবশ্য অনেক বাসের চালক ট্রিপপ্রতি আড়াই হাজার টাকাও পান। দামি বাসের চালক-সহকারীদের বেশি টাকা দেন মালিকরা। নয় বছর ধরে দূরপাল্লার বাসে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন ঝিনাইদহের মামুন সুলতান। তিনি বলেন, বেতনের বাইরেও আমরা বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করি। এটা মালিকরাও জানেন। কারণ এটা না করলে আমাদের পোষাবে না।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান বলেন, কখনো কখনো চার ঘণ্টার রাস্তা যেতে ১৬ ঘণ্টা লেগে যায়। কিন্তু এজন্য মালিক কখনোই শ্রমিককে ‘ওভারটাইম’ দেন না। সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুরও জানান একই পরিস্থিতির কথা। তিনি বলেন, অনেক সময় মহাসড়কে জ্যামের কারণে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতেই ১৮ ঘণ্টা লেগে যায়। ওখান থেকে আরো ১৬ ঘণ্টা পর ঢাকায় এসে ‘ট্রিপ’ শেষ করলে পারিশ্রমিক কিন্তু ওই এক দিনেরই। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, তারা চাকরি করলে বিষয়টা আমরা (মন্ত্রণালয়) দেখতে পারতাম।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীর লেগুনা সার্ভিসের অধিকাংশ চালক ও সহকারী শিশুশ্রমিক। দ্বীপ জেলা ভোলা থেকে ঢাকায় আসা ১৫ বছরের বাবু গাবতলী থেকে মিরপুর-১২ রুটের লেগুনা চালক। বাংলাদেশের খবরকে সে বলে, সকাল ৬টায় নামি, রাত ১২টায় বন্ধ করি। বাবুর গড় আয় দৈনিক ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। তার ১০ বছর বয়সী সহকারীর আয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। একই রুটের আরেক লেগুনার আট বছর বয়সী সহকারী রাব্বী জানায়, সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা অবধি কাজ করে সে পায় দেড় শ’ টাকা। অবশ্য তার ‘ওস্তাদ’ (চালক) দাবি করে, রাব্বীকে দৈনিক ৩০০ টাকা দেওয়া হয়।
প্রশ্নবিদ্ধ শ্রমিক নেতৃত্ব : পরিবহন শ্রমিক লীগ নেতা ইনসুর জানান, শ্রমিক ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকলেও মালিকদের কাছ থেকে শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র আদায় করতে পারেনি। কারণ ফেডারেশনের নেতারা আর শ্রমিক নেতা নেই। তারা এখন মালিকদের প্রতিনিধি, অধিকাংশই নামে-বেনামে গাড়ির মালিক। তবে ইনসুর ছাড়া এমন অভিযোগ আর কেউ করেন না দাবি করে ফেডারেশনের নেতা ওসমান বলেন, আমি শ্রমিক রাজনীতি করি বলে আমার সন্তান পরিবহন ব্যবসা করতে পারবে না, এমনটা হতে পারে না। দেখতে হবে শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলি কি না। আমরা কিন্তু কখনো আপস করিনি, ৩৫ বছর ধরে নিয়োগপত্রের দাবি জানিয়ে আসছি। এ ব্যাপারে ১৯৮০ সালে চুক্তি হয়েছে, ৮২ সালে সরকারি বিধি হয়েছে। কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না। এখানে সরকারেরও অসহযোগিতা আছে। ওসমান ক্ষোভের সঙ্গে জানান, রাস্তায় যখন গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করা হয় তখন চালক-সহকারীর নিয়োগপত্রও চাওয়ার কথা। বিআরটিএতে শ্রমিকের নিয়োগপত্র ছাড়া কোনো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হওয়ারই কথা না।
প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল বলেন, আমরাও বলেছি, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া উচিত। কিন্তু মালিক-শ্রমিক কোনো পক্ষই খুব বেশি আগ্রহী না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারাও ভাবছেন। এ ব্যাপারে সরকার ও শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, পরিবহন খাত মূলত ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে। প্রকৃত মালিক-শ্রমিকের নেতৃত্ব কোথাও নেই। তিনি বলেন, শ্রমিক নেতাদের প্রত্যেকের গাড়ির ব্যবসা আছে। আবার মালিক সংগঠনের অনেকে সব গাড়ি বহু আগে বিক্রি করেও নেতা হয়ে বসে আছেন।