রোদ-বৃষ্টির এমন মাতাল আচরণে নিজেকে সুস্থ রাখা কঠিন আর শিশুদের ক্ষেত্রে তা একটু বেশিই কঠিন। বয়সের কারণেই শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড়দের তুলনায় একটু কম। গরমে অতিরিক্ত ঘাম থেকে অথবা হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ধরনের আবহাওয়ায় সর্দিকাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে মারাত্মক নিউমোনিয়া পর্যন্ত হতে পারে।
শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগ খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, যদি সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা করা না হয়। সারা বছরই কম-বেশি এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বিশেষ করে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ফুসফুসের ইনফেকশনও বেড়ে চলেছে। শিশুরা, বিশেষ করে দুই-আড়াই বছর বয়সীরা যেহেতু নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারে না, তাই তাদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। এজন্য প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার নিউমোনিয়ার লক্ষণ কী কী।
* নবজাতকের ক্ষেত্রে হালকা জ্বর, কান্নাকাটি করা, খাওয়া-দাওয়া করতে না চাওয়া, শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের খাঁচা ভেতরে ডেবে যাওয়া- এসব লক্ষণের যেকোনো একটি দেখা দিলে অতিসত্বর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
* এক থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও এসব উপসর্গের পাশাপাশি কাশি থাকতে পারে।
* ছয় মাস থেকে দুই-তিন বছর বয়সের শিশুদের জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট থাকতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জ্বর ও কাশির সঙ্গে হয়তো শুধু খিটখিটে ভাব, নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
* দুই-তিন বছরের বেশি বয়সী শিশুরা সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা- এসব লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে।
এসব লক্ষণের যেকোনো একটি দেখা দিলে অতিসত্বর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো না হলে নিউমোনিয়ায় এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
নিউমোনিয়ার কারণ এবং চিকিৎসা
নিউমোনিয়া সাধারণত ব্যাক্টেরিয়া অথবা ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে রোগের কারণ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। যদি ব্যাক্টেরিয়ার ইনফেকশন হয়, তখন আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিই। যদি মৃদু বা মাঝারি স্টেজের হয়, তাহলে আমরা সাধারণত বাড়িতেই মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে থাকি। কিন্তু মারাত্মক আকার ধারণ করলে হাসপাতালে ভর্তির বিকল্প নেই।
আসুন, জেনে নেওয়া যাক নিউমোনিয়া প্রতিরোধের উপায় কী
আমরা বড়রা একটু সচেতন হলেই শিশুদের ঠান্ডাজনিত অসুস্থতাকে অনেক কমিয়ে আনতে পারি। খুবই সাধারণ কিছু বিষয়, যেমন—
* শিশুদের স্কুলব্যাগে সবসময় পরিষ্কার রুমাল বা টিস্যু দিয়ে দিতে হবে এবং শিখিয়ে দিতে হবে ঘেমে গেলে যেন মুছে নেয়।
* বৃষ্টির সময় ছাতা বা রেইন কোট ব্যবহার করতে হবে।
* হালকা ঠান্ডা লাগলে আদা চা, দুধ, স্যুপ সহনীয় মাত্রায় গরম করে খেতে দিতে হবে।
* হঠাৎ বাইরের গরম থেকে এসেই গোসল কিংবা এসি ব্যবহার করা যাবে না।
* এসি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাইরের এবং ঘরের তাপমাত্রার পার্থক্য ৫-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া উচিত নয়।
এছাড়া শিশুর পুষ্টি, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি পর্যাপ্ত থাকলে অসুখের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। এজন্য ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই, যেটাকে আমরা বলি এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং। আর ৬ মাস বয়সের পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার, যেমন- ফলমূল, মাছ, মাংস, শাকসবজি খাওয়াতে হবে। এছাড়া ধুলাবালি, হাঁচিকাশির সময় রুমাল ব্যবহার করাতে হবে। শিশুদের উপস্থিতিতে কোনোভাবেই ধূমপান করা যাবে না। তাছাড়া নিউমোনিয়ার জন্য শিশুদের ভ্যাক্সিন দেওয়া যেতে পারে।
বাবা-মায়ের ব্যস্ততা অথবা নতুন বাবা-মাদের অভিজ্ঞতা না থাকায় নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো সহজেই চোখ এড়িয়ে যায়, যা শিশুর প্রাণঘাতীও হতে পারে। অথচ সঠিক লক্ষণগুলো জানা থাকলে এবং পদক্ষেপ নিলে সঠিক চিকিৎসায় এই রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়, কোনো জটিলতা ছাড়াই।
ডা. কাজী আলিফা জাহান
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল