ভাস্কর শিল্পী আইভি জামান
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলা চর্চার পুরোধা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আমাদের গর্ব ও দেশের অহংকার তাঁর সংস্পর্শে এসে চারুকলায় ভর্তি। পরীক্ষার সময়ের পরে এসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পাওয়া।
ছবিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের প্রতিকৃতি ও দুর্ভিক্ষ চিত্রের ছবি।
উনিশ-শ বাষট্টি সালে হামিদুজ্জামান জানতে পারেন ঢাকায় চারুকলা পড়ার সুযোগ আছে। বাড়িতে বাবার কাছে গিয়ে বললেন ঢাকাতে একটা আর্ট কলেজ আছে...ওখানে যেতে চাই। ভৈরব কলেজে পড়তে যেয়ে আর্ট কলেজের কথা শুনেছেন। গচিহাটা ডাকঘরের পোস্টমাস্টার তাঁর বাবাকে বললেন আপনার ছেলে চারুকলায় পড়াশোনা করতে চায়। চারুকলায় আমি গেছি একবার, আপনি ওরে নিয়া যান। যদি ভালো লাগে ভর্তি করান।
হামিদুজ্জামান বাবার সাথে প্রথম ঢাকা শহরে এলেন। ঢাকা শহর তখন তার কাছে মস্তবড় এক শহর। প্রথমে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন এ নেমে নতুন ঢাকা শহরে এলেন। এসে সরাসরি আবেদীন স্যারের খোঁজে তার শান্তিনগরের বাসায় গেলেন বাবাসহ। উনি বারান্দায় বসে ছিলেন পুরাতন একটি বাড়িতে। এই প্রথম জয়নুল আবেদীনের সংস্পর্শে এলেন। উনি খুব সহজ সরল লোক। হামিদুজ্জামানের বাবা বললেন ‘ও তো চারুকলায় ভর্তি হতে চায়। আবেদীনে স্যার বললেন কালকে চারুকলায় নিয়ে আসেন আমি ভর্তি করিয়ে দেব। হামিদুজ্জামান তখন অনেক দেরি করে এসেছে। তখন অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। আবেদীন স্যার বললেন ওর কিছুই লাগবে না। তখন ইন্টারভিউ ছাড়া আবেদীন স্যার ভর্তি করাতেন না। আবেদীন স্যার বললেন কাগজপত্র যা আছে দেখাও। হামিদুজ্জামান নিজের জমানো আঁকা ছবি দেখালেন।
আরো কাগজপত্র যা আছে দেখাও। সব দেখালেন আবেদীন স্যার লিখে দিলেন অ্যাডমিশন করার জন্য। হামিদুজ্জামান চারুকলায় ভর্তি হলেন। চারুকলায় দেখতে পান সবাই স্মার্ট। ক্লাস শুরু করছে ড্রইং সুন্দর করছে। দেখতে পেয়ে হামিদুজ্জামান একটু চিন্তিত। আর একটুখানি পিছিয়ে আছেন, যেহেতু কোর্সটা শুরু হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে লাগলেন।...এইভাবে ফাস্ট ইয়ারটা গেল, স্কেচ করতেন অনেক বেশি।
মুস্তাফা মনোয়ার স্যার ক্লাশ শিক্ষক ছিলেন । কবি গোলাম মোস্তাফার ছেলে মুস্তাফা মনোয়ার, উনি খুব ভালো জলরং করতেন। হামিদুজ্জামান উনার ছাত্র তার জেদ ছিল একটা কিছু করতে চায়। যেহেতু পড়াশোনা বাদ দিয়ে চারুকলায় পড়তে এসেছেন। মোস্তাফা মনোয়ার স্যার হামিদুজ্জামানকে স্নেহ করতেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে এগিয়ে নিতে।
একটা ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। একদিন ক্লাসে এসে ডংকিতে (ডংকি হলো চারুকলায় বসার জন্য সিট একটু লম্বা সামনে স্টান ড্রুইং করার জন্য ) ঘুমিয়ে গেছে।
মুস্তাফা মনোয়ার স্যার ছিলেন। উনি বললেন ওকে ডেকো না ঘুমাতে দাও। ওর স্কেচ খাতা কই...উনি নিয়ে দেখেন প্রচুর স্কেচ। কারণ ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে সারা রাত জেগে স্কেচ করেছিল, খাতা ও প্রায় শেষ। দেখে উনি খুব খুশি হয়েছেন আর বলেছেন, দেখেছ, এই ছেলে কি রকম ছিল আর কিছু দিনের মধ্যে কতটা চেঞ্জ হয়েছে? প্রচুর খাটে কাজ করে ঘুম থেকে উঠে দেখে ক্লাশে কেউ নেই। ঘুমিয়ে ক্লাশ শেষ করে। তাঁর ক্লাশমেটরা বলল, স্যার তোমাকে খুব পছন্দ করেছে, তোমার কাজ দেখে ভালো বলেছে, আমাদের ডাকতে নিষেধ করেছেন তাই আমরা ডাকিনি। এই ব্যাপারটা তাকে কাজে উৎসাহিত করে।
জয়নুল আবেদীন স্যার হামিদুজ্জামানকে একদিন ডাকলেন। খুব ভয়ে ভয়ে দেখা করলেন। আবেদীন স্যার এর সামনে যেতে খুব একটা সাহস ছিল না। কাছে যাওয়ার পর উনি বললেন তোমার এক্সিবিশনে যে কতগুলো ওয়াটার কালার আছে, এগুলো আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে ফ্রেম করে দিচ্ছি। আমাদের প্রিন্ট মেকিংয়ের অনেকগুলো বড় বড় ফ্রেম ছিল। টিচাররা ইউজ করতেন মাঝে মধ্যে, গিয়ে দেখে ছবিগুলো সব ফ্রেম করা। হামিদুজ্জামান যে কয়েকটি ওয়াটার কালার দিয়েছিলেন সবগুলো টাঙ্গিয়ে দিতে বললেন। তারপরে আবার ডেকে বললেন তোমার এক্সিবিশনে যে কতগুলো ছবি আছে আমি কিনে নিলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে বললেন আমার ছবি নিয়ে আপনি কি করবেন। উত্তরে উনি বললেন আমার যে বিদেশি অতিথি আসে ওদের উপহার দেব।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বলেছেন, জলরং তোমার ভালো হয়, তুমি ধরে রেখ, দেখবে এই জলরং তোমাকে বহু দূর নিয়ে যাবে।
তৃতীয় বর্ষে উঠার সময় ক্লাশে ফাস্ট হওয়ার সুনাম অর্জন করেন। স্পেন প্রবাসী মনিরুল ইসলাম, সেলিমা জহির উদ্দীন হামিদুজ্জামানের এক ক্লাশ অগ্রজ ছিলেন।