শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার আলামত

সরকার এখন ২৪৬টি কলেজের ‘জিও’ জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে

সংরক্ষিত ছবি

শিক্ষা

শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার আলামত

জাতীয়করণে ২৪৬ কলেজের ‘জিও’ প্রস্তুত হচ্ছে, বাদ ৫২

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই, ২০১৮

জাতীয়করণের জন্য ঘোষিত কলেজগুলোর ‘জিও’ জারির জন্য সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। যদিও মন্ত্রণালয় শিক্ষক নেতাদের সাবধান করেছে, তারপরও ঘোট পাকানোর গোপন তৎপরতা থামছে না। এর ফলে কলেজ শিক্ষায় ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কয়েক দিন আগেই জানিয়েছেন, কলেজগুলোর জাতীয়করণের ‘জিও’ যাতে দ্রুত জারি করা যায়, সে চেষ্টা চলছে। এজন্য প্রয়োজনীয় যে ধাপগুলো শেষ করা দরকার, এখন তা করা হচ্ছে। এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। তারা বলছেন, জাতীয়করণ হওয়া কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডার মর্যাদা দিলে সারা দেশের সরকারি কলেজ অচল ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সব পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। এ উদ্দেশ্যে সাধারণ শিক্ষকরা বিসিএস শিক্ষা সমিতির ওপর চাপ তৈরি করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে ২৯৮টি কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু মামলাসহ নানা জটিলতায় ৫২টি বাদ দিয়ে সরকার এখন ২৪৬টি কলেজের ‘জিও’ জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে ২৪৬টি কলেজের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী এসব সারসংক্ষেপে সই করলেই ‘জিও’ জারি হয়ে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয়করণ হতে যাওয়া বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হতে পারবেন, আবার ননক্যাডার হিসেবেও থাকতে পারবেন। এ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি চাওয়া হবে। আর এতেই চটেছেন বিসিএস শিক্ষা সমিতির সদস্যরা। এ সমিতি সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন। সরাসরি বিসিএস পাস করে সরকারি কলেজের শিক্ষক হতে হয়। সংগঠনটি বলছে, বিসিএস পরীক্ষা না দিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়া যাবে না।

একাধিক সরকারি কলেজের শিক্ষক বলেছেন, জাতীয়করণের তালিকাভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণের জন্য তৈরি নতুন বিধিমালার খবরে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষা ক্যাডারদের পক্ষে বলা হয়েছে, আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে বিধিমালা বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। বিধিমালাটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।

তবে সরকারি কলেজ শিক্ষকদের এমন হম্বিতম্বিতে বিসিএস শিক্ষা সমিতির সভাপতি ও মহাসচিবকে মন্ত্রণালয় থেকে সাফ বলে দেওয়া হয়েছে, এ অযৌক্তিক দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। বিষয়টি শুধু শিক্ষার নয়, এর সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয়ও জড়িত। এরপরই ফুঁসে উঠতে শুরু করে বিসিএস শিক্ষা সমিতি। এরই মধ্যে বিধিমালাটি বাতিলের দাবিতে একটি অংশের গতকাল নায়েমে জরুরি বৈঠক করার কথা থাকলেও সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সেটি অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই বৈঠকে সমিতির সভাপতি আই কে সেলিম উল্যাহ খন্দকারের আগ্রহে সাবেক নেতাসহ বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আই কে সেলিম উল্যাহর এমন প্রস্তাবে সমিতির প্রগতিশীল সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সমিতির মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী সরাসরি এই প্রস্তাবের পক্ষে নামেননি। তিনি জাতীয়করণ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক রকম, বিসিএস শিক্ষা সমিতিতে এক রকম, আবার জাতীয়করণ হতে যাওয়া কলেজ শিক্ষকদের সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আরেক রকম কথা বলছেন। এতে ভীষণ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিএস শিক্ষা সমিতির একজন সদস্য বলেছেন, বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের ইস্যুকে কেন্দ্র করে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্ল্যাহ খন্দকার ও মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। সভাপতি সমিতির সাবেক নেতাদের বৈঠক ডাকার কথা বললেও মহাসচিবের তাতে সায় নেই। উল্টো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সভাপতিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে তিনি বিষোদগার করছেন। তিনি বলেন, জাতীয়করণ ইস্যুতে বিসিএস শিক্ষা সমিতির ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু নেতা সভাপতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে সরকারি কলেজের বেশিরভাগ সাধারণ শিক্ষক সভাপতির পক্ষে। মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী প্রকাশ্যে ‘আওয়ামী লীগ’ কিন্তু ভেতরে ‘অ্যান্টি আওয়ামী লীগ’ হওয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষক নেতারা তাকে সমর্থন করছেন।

জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্যাহ খন্দকার মহাসচিবের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সাংগঠনিক কিছু মতপার্থক্য আছে। সমিতির সাবেক নেতাদেরকে নিয়ে এখনো বসা হয়নি। তবে কলেজ শিক্ষার স্বার্থে এমন বিরোধ না থাকাই ভালো। মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতীয়করণ হওয়া কলেজ শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন মতামত দিয়ে বলেছে- কলেজগুলোর অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সহকারী অধ্যাপকদের ননক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া এসব কলেজে কোনো পদ শূন্য হলে ক্যাডার পদ থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায়। পিএসসি আরো বলেছে, জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষকরা পিএসসির অধীনে বিশেষ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে ক্যাডার হতে পারবেন। তবে পুরো বিষয়টিই এখন আইন মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই হচ্ছে।

বিসিএস শিক্ষা সমিতির সভাপতি আই কে সেলিম উল্যাহ খন্দকার এই ধারাটিতে আপত্তি করে বলেছেন, সরকার তাদেরকে এতকিছু দেওয়ার পরও বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার হওয়ার সুযোগ রাখবে কেন। বিশেষ বিধানের মাধ্যমে ক্যাডারভুক্তির সুযোগ রাখা হলে কার্যত প্রায় সবাই ক্যাডারভুক্ত হয়ে যাবেন। তাতে মামলা-মোকদ্দমা বাড়বে। কলেজ শিক্ষা সঙ্কটে পড়বে।

তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, জাতীয়করণ হতে যাওয়া বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা ক্যাডারভুক্ত হতে পারবেন, আবার ননক্যাডার হিসেবেও থাকতে পারবেন। এ দুই ব্যবস্থা রেখেই নতুন আত্তীকরণ বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এর ফলে দুই বছর ধরে কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে ক্যাডার ও ননক্যাডার নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তার নিরসন হবে।

যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ নেই, সেগুলোতে একটি করে কলেজ জাতীয়করণের জন্য ২০১৬ সাল থেকে তালিকাভুক্তির কাজ শুরু করে সরকার। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ২৮৩টি কলেজের সব সম্পত্তি ইতোমধ্যে সরকারের নামে দান (ডিড অব গিফট) করা হয়েছে। এ কলেজগুলোতে ৮ থেকে ১০ হাজার শিক্ষক আছেন। নিয়মানুযায়ী প্যাটার্ন শিক্ষকরা সরকারি হবেন। কিন্তু তাদের অবস্থান, মর্যাদা, বদলি ও পদোন্নতি কীভাবে হবে, তা দুই বছরেও ঠিক না হওয়ায় সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়নি। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের দাবি, ওইসব কলেজের শিক্ষকদের ননক্যাডারে রাখতে হবে। এজন্য তারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন। আর জাতীয়করণ হতে যাওয়া কলেজ শিক্ষকরা চান পুরনো নিয়মে তাদের ক্যাডারভুক্ত করতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এতদিন যেসব কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে, সেগুলোর শিক্ষকরাও ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন। এখন যেহেতু একসঙ্গে এতগুলো কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে, সেখানে সবাইকে ক্যাডারভুক্ত করলে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডারভুক্ত হওয়া কর্মকর্তারা বৈষম্যের শিকার হবেন। আবার যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ক্যাডারভুক্ত করা হয়েছে, তাই এই সুযোগ একেবারে বন্ধ করা হলে মামলার মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে।

জাতীয়করণ হতে যাওয়া কলেজ শিক্ষকদের অনেকের চাকরির বয়স ৮ থেকে ১০ বছর হয়ে গেছে। কারো ১৫ বছরও হয়ে গেছে। ক্যাডারভুক্ত হলে তাদের চাকরি হবে সর্বশেষ বিসিএসে উত্তীর্ণ ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিচে। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের অনেকে এটি চান না। আবার অনেকেই পিএসসির অধীনে পরীক্ষা দিতে চাইবেন না। হয়তো প্রভাষকদের অনেকে ক্যাডারভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads