গৌতম গুহ রায়
আমার তৃতীয় কবিতার বই সেই স্কুলছাত্রীটিকে নিয়ে লেখা কিছু যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, যা সেই সপ্তদশীকে রক্তাক্ত ও প্রাণহীন মৃতদেহে পরিণত করেছিল। রেখা তামাং। সেই বইয়ের শেষ লাইনটা এমন ছিল : একদিন, ক্রোধের তাপে, অভিমানে উত্তাপে/বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে তারা, তবুও জানি/পাহাড়ের গায়ে রঙিন গুল্ম হয়ে আছে রেখা তামাং-এর কালো চোখ।
দার্জিলিং, আমার কাছে শুধু নিসর্গের মন ভোলানো রূপ নিয়ে নয়, বরং সে বিরাট হূদয় ও শিশুর মতো উদ্দাম কিছু প্রকাশ্য ও আলোছায়ার রহস্যমাখা মানুষের কথাও। এই পাহাড়-কথায় আছেন একজন আকাশের মতো চিত্তের শেরপা বনরক্ষী, আবার রয়েছে সম্প্রীতির জন্য কলিজা উজাড় করা সপ্তদশী স্কুলছাত্রী।
মাধ্যমিক দিয়ে পাহাড়ের ডাকে সান্দাকফু, কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের ডাকে ফেরার পথে জঙ্গলের পথ ধরলাম আমরা তিন বন্ধু। ঝিরঝির বৃষ্টি। ক্রমেই অন্ধকার নামল। ঝিঁঝিঁ ডাকা আতংকে বুকের ভেতরটা হিম হতে শুরু হয়েছে, এমন সময় অশরীরী আত্মার মতো সামনে এক শেরপা, নেশায় তার পা টলছিল, ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে শুরুতেই বলল, কৈ ডরো মৎ, আপ হামারো মেহমান, ডরো মৎ। সে ওই অরণ্যের ‘ফরেস্ট গার্ড’ (শেরপাজি বলেই ডাকতে বলেন, পুরো নাম কিছুতেই বলেননি)। তার অনুরোধে প্রায় এক কিলোমিটার পথ তাকে অনুসরণ করে পৌঁছলাম তার ছোট্ট কাঠের বাসায়। একটা কুকুর ও সে সেই কোয়ার্টারের বাসিন্দা।
নাগরিক মন নিয়ে ইতস্তত করতে থাকা আমাদের এক প্রকার জোর করেই তার ঘরে ঢুকিয়ে দিল সে। নেশা মেশানো গলায় শুধু একটাই কথা তার, আপ হামারো মেহমান, রুকিয়ে। এহি রেডিও লিজিয়ে, গানা শুনিয়ে, ম্যায় আতাহু। এই বলে গোটা বাসায় আমরা তিন অপরিচিত আগন্তুককে রেখে সে কোথাও গেল। ওদিকে বৃষ্টি বাড়ছে, কুকুর ও সেই শেরপা ফরেস্ট গার্ড কোথাও গেছেন।
আমরা ভয়ে ভয়ে আধো অন্ধকারে চুপ করে বিছানায় বসে। ঘণ্টাখানেক পরে সে এলো। হাতের থলেটা দেখে বুঝলাম যাওয়ার কারণ, চাল। আমরা বাকরুদ্ধ, সেই চাল সেদ্ধ করে আমাদের জন্য ভাত বাড়লেন, সঙ্গে ঘরে রাখা শুয়োরের মাংস, সেদ্ধ করে তেলে আচারের মতো করে রাখা ছিল। পরদিন প্রায় চার কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে দিলেন রিম্বিকের রাস্তায়। আজ এই দাউ দাউ আগুনের পাহাড়ে সেই শেরপার কথা খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে পাহাড়ের এসব পাহাড়ের মতো বিশাল মানুষের কথা।
পাহাড়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যদিও জন্মাবধি। ঠাকুরদা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী, পোস্টিং ছিল দার্জিলিং, পরে মেজো জ্যাঠাও সেখানেই কাজ করেন। তার ফলে শৈশব থেকেই পাহাড় আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান। ছাত্রজীবনে ট্রেকিং প্রথম প্রেম, তাই ইয়ুথ হোস্টেলের মেম্বার হয়ে অন্য উড়ানে সওয়ার হওয়া, সেই পাহাড়, বারবার। কোনোদিন মনের কোণে ভুলেও আসেনি যে, এই পাহাড় জ্বলবে ভিন্ন হওয়ার দাবিতে। কিন্তু হলো।
১৩ এপ্রিল ১৯৮৬ পৃথক গোর্খাল্যান্ড ও ১৯৫০-এর ভারত-নেপাল চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে জিএনএলএফ। ওইদিন কালো পতাকা দিবস পালন করে, সেদিন আমি সদ্য ফালুট থেকে নেমেছি, সঙ্গে দুই বিদেশি বন্ধু। ওরাও চিন্তায় পড়ে যায়, যদিও আমরা নেমে আসি। কিন্তু এরপর অনেক জল গড়িয়েছে ওই মেচি মহানন্দা দিয়ে।
আমার তৃতীয় কবিতার বই সেই স্কুলছাত্রীটিকে নিয়ে লেখা কিছু যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, যা সেই সপ্তদশীকে রক্তাক্ত ও প্রাণহীন মৃতদেহে পরিণত করেছিল। রেখা তামাং। সেই বইয়ের শেষ লাইনটা এমন ছিল :
একদিন, ক্রোধের তাপে, অভিমানে উত্তাপে
বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে তারা, তবুও জানি
পাহাড়ের গায়ে রঙিন গুল্ম হয়ে আছে রেখা তামাং-এর কালো চোখ।