রাজশাহীর জীবন আর প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এখানকার মানুষের মুখের ভাষায় আছে এক ধরনের সারল্যমাখা টান। রাজশাহীরবাসী অতিথিপরায়ণও বেশ। তাই আমকে কেন্দ্র করে সেখানে গেলেও ওই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া হলে আফসোস করতে হবে। পদ্মার তীরে অবস্থিত প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় এ শহরটির সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্থান। রাজশাহী শহরের মধ্যেই বেশকিছু বিনোদনের জায়গা আছে। এর মধ্যে পদ্মার পাড় অন্যতম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিও মনে গেঁথে থাকবে। আছে চিড়িয়াখানাও। ঘুরে আসা যায় বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর থেকেও। রাজশাহী সদর হাসপাতালের সামনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সংগ্রহশালা এ জাদুঘরটি। ১৯১০ সালে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জাদুঘরের আটটি গ্যালারিতে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, প্রায় এক হাজার পোড়ামাটির ফলক ছাড়াও হাজারো নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে। বছরের এই সময়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। এ ছাড়াও রাজশাহী শহর থেকে খানিক দূরের কিছু পথও মাড়িয়ে আসা যায়। বাঘা উপজেলা আর পুটিয়া রাজবাড়ী সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়-
বাঘা : রাজশাহী থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বাঘা উপজেলা। এ উপজেলার সব জায়গাতেই আছে আমের বাগান। বাগান দেখতে বাঘা গেলে এক ফাঁকে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ। প্রাচীন এ মসজিদের চারপাশে চারটি ও মাঝখানে দুই সারিতে পাঁচটি করে মোট দশটি গম্বুজ আছে। মসজিদের পূর্ব পাশে আছে পাঁচটি দরজা। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের চারটি দরজাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই মসজিদটি প্রায় ২৩.১৬ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২.৮০ মিটার প্রস্থের। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের ছাদ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পরে গম্বুজসহ ছাদটি পুনর্নির্মাণ করে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে প্রচুর পোড়া মাটির ফলক। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত একটি বিশেষ নামাজ কক্ষ আছে। এটি নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকে মনে করেন এটি মহিলাদের নামাজের জায়গা ছিল। আবার অনেকের মতে, কক্ষটি শুধু সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে করাচিতে সংরক্ষিত মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের ওপরের শিলালিপি অনুযায়ী, সুলতান নসরত শাহ মসজিদটি ১৫২৩ সালে নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই আছে একটি কবরস্থান। বেশ কয়েক বুজুর্গ ব্যক্তি শায়িত আছেন এখানে। জনশ্রুতি আছে, হজরত শাহ দৌলা দানেশ মন্দ (র.) পাঁচজন সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাঘায় আসেন খ্রিস্টীয় ১৫০৫ সালে। সুলতান নসরত শাহও তার ভক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। শাহ দৌলা এ অঞ্চলে বাঘের পিঠে চড়ে বেড়াতেন বলে জায়গাটির নাম বাঘা। এ কথা প্রচলিত আছে লোকমুখে।
রাজশাহী থেকে বাঘা যাওয়ার সহজ উপায় হলো বাস। রাজশাহী সদর বাস টার্মিনাল থেকে বাঘার বাস ছাড়ে। ভাড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। যাওয়ার পাথে বানেশ্বর আম হাট দেখে যেতে পারেন। রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বসে বানেশ্বরে।
পুঠিয়া রাজবাড়ী : ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ী। এ প্রাসাদটি ঘিরে চারপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি নজরকাড়া মন্দির। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক থেকে সামান্য দক্ষিণে পুঠিয়া রাজবাড়ীর প্রবেশপথ। এখানে পুকুর পাড়ে প্রথমেই আছে বিশাল আকারের শিব মন্দির। পুঠিয়ার রানি ভুবন মোহিনী দেবী ১৮২৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্যেক দিকে ৬৫ ফুট দীর্ঘ শিব মন্দিরটি একটি উঁচু ভিতের ওপর নির্মিত এবং এর চার কোনায় চারটি ও কেন্দ্রে একটি রত্ন আছে। মন্দিরের দোতলায় একটি মাত্র কক্ষ, যার চারপাশে দুই স্তরের বারান্দা বিদ্যমান। মূল কক্ষের ভেতরে আছে কষ্ঠি পাথরের শিব লিঙ্গ। পুরো মন্দিরের দেয়াল পৌরাণিক কাহিনী চিত্রখচিত। এশিয়ার অন্যতম বড় শিব মন্দির বলা হয় পুঠিয়ার এ মন্দিরকে। এর লাগোয়া পূর্ব পাশে গোল গম্বুজ আকৃতির আরেকটি ছোট মন্দির আছে।
শিব মন্দির ছাড়িয়ে একটু দক্ষিণে গেলেই চোখে পড়বে চারতলার দোলমন্দির। চতুর্থ তলার উপরে আছে গম্বুজাকৃতির চূড়া। প্রত্যেক তলার চারপাশে আছে টানা বারান্দা। আনুমানিক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এটি নির্মাণ করেছিলেন পুঠিয়ার আরেক রানি হেমন্ত কুমারী দেবী। দোলমঞ্চের সামনের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশাল প্রাসাদটিই পুঠিয়া রাজবাড়ী। রানি হেমন্ত কুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানি শরৎসুন্দরী দেবীর সম্মানার্থে ১৮৯৫ সালে নির্মাণ করেন এ রাজবাড়ী। ভবনের পূর্ব পাশে আছে রানি পুকুর। রাজবাড়ীর সম্ভ্রান্ত মহিলাদের গোসলের জন্য রানি পুকুরে আছে দেয়াল ঘেরা শান বাঁধানো ঘাট।
পুঠিয়া রাজবাড়ীর প্রাচীরের ভেতরে পোড়ামাটির অলঙ্করণে ঢাকা গোবিন্দ মন্দির। বর্গাকারে নির্মিত এ মন্দিরের প্রত্যেক পাশের দৈর্ঘ্য ১৪.৬ মিটার। কেন্দ্রীয় কক্ষ ছাড়াও মন্দিরের চারপাশে বার্গাকার চারটি কক্ষ আছে।
এই মন্দির আড়াইশ’ বছরের পুরনো বলে প্রচলিত থাকলেও এর গায়ে চিত্র ফলক দেখে ধারণা করা হয়, এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত। এ মন্দিরের দক্ষিণ পাশে প্রাচীরের বাইরে অলঙ্করণ সমৃদ্ধ ছোট আরেকটি মন্দির রয়েছে।
পুঠিয়া রাজবাড়ীর পশ্চিম পাশে দীঘি। তার পশ্চিম তীরেই রয়েছে পূর্বমুখী বড় আহ্নিক মন্দির। কারুকার্যমণ্ডিত এ মন্দিরের নির্মাণশৈলী বেশ আকর্ষণীয়।
বড় আহ্নিক মন্দিরের পাশে দক্ষিণমুখী অবস্থানে আছে গোপাল মন্দির। ১৬.৩০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০.৪৭ মিটার প্রস্থের এ মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার। রাজশাহী থেকে বাসে সহজেই যাওয়া যায় পুঠিয়া। রাজশাহী থেকে খুব সকালে বেরিয়ে দুপুর পর্যন্ত বেড়াতে পারেন বাঘায়। দুপুরের পর চলে যেতে পারেন পুঠিয়া। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেড়িয়ে রাজশাহী ফিরতে পারেন।