রাজনীতির বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নারী

রুশনারা আলী

ছবি : সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

রাজনীতির বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নারী

  • প্রকাশিত ১ জুলাই, ২০১৮

বাংলাদেশি নারীরা প্রতিনিয়ত তাদের মেধা, কর্মনিষ্ঠা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এসেছে প্রতিটি জায়গায়। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে, হিমালয় জয় করে তারা এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। দেশীয় রাজনীতিতে তো বটেই, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে নিজেকে তুলে ধরেছেন স্বমহিমায়। বিশ্বের গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স। সাতশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ সংসদ আলোকিত করে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন নারী। তারা হলেন রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও ড. রূপা হক। এছাড়া জুনে কানাডার প্রাদেশিক নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আরো এক বঙ্গকন্যা ডলি বেগম। বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন এমন চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী রাজনীতিবিদকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন, লিখেছেন- মনিরা তাবাস্সুমকামরুল আহসান

 

রুশনারা আলী : হাউস অব কমন্সে তিনিই প্রথম

রুশনারা আলী প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী, যিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। গত বছরের নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। ২০১০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো জয়ী হয়েছিলেন। লেবার পার্টির সদস্য এ রাজনীতিবিদ ব্রিটিশ রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বার্নলে, ওল্ডহ্যাম ও ব্র্যাড ফোর্ডে ২০০১ সালের দাঙ্গার ফলে স্থানীয় ও জাতীয় মাধ্যমকে গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন তিনি। তখন থেকেই তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

২০০৭ সালে তিনি লেবার পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনীত হন। এরপর পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো থেকে ২০১০ সালে রুশনারা আলী প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রায় ৭০ শতাংশ বাঙালি অধ্যুষিত এ অঞ্চল থেকে তিনি বিজয়ী হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১১ হাজার ৫৭৪ ভোট বেশি পেয়ে। সেবার তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১১,৫৭৪টি। এবার তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী শার্লট চেরিকোর থেকে ৩৫ হাজার ৫৯৩ ভোট বেশি পেয়ে।

রুশনারা আলীর জন্ম সিলেট জেলার বিশ্বনাথে, ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ। মাত্র ৭ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে তিনি লন্ডনে চলে আসেন এবং বেড়ে ওঠেন টাওয়ার হ্যামনেটসে। সেখানে তিনি মালবেরি স্কুল ফর গার্লস এবং টাওয়ার হ্যামটেস কলেজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জন’স কলেজ থেকে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। মাইকেল ইয়াংয়ের গবেষণা সহকারী হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এর আগে রুশনারা আলী একজন গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আইপিপিআরে।  ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাকে সেনা অভিযানের ব্যাপারে যখন হাউজ অব কমন্স ভোটের আয়োজন করে, তখন তা থেকে বিরত থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ব্রিটিশ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছেন।

2

টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক  : ক্যামডেনের প্রথম নারী কাউন্সিলর

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি টিউলিপের। সে সময় যোগ দেন ব্রিটেনের লেবার পার্টিতে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গ্রেটার লন্ডন অথরিটির হয়ে কাজ করেছেন তিনি। রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন ফিলিপ গোল্ড অ্যাসোসিয়েটসের। কাজ করেছেন সেভ দ্য চিলড্রেনসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে। শুধু ব্রিটেনের রাজনীতিতে নয়; আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও পরিচিত মুখ টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। ২০১৫ সালে ব্রিটেনের ৫৬তম সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো জয়ী হয়েছিলেন টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। ২০১৭ সালে জয়ী হয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো। লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে প্রথমবার ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ প্রার্থীকে পরাজিত করেছিলেন ১ হাজার ১৩৮ ভোটের ব্যবধানে। দ্বিতীয়বার লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী ক্লেয়ার লুইচ লিল্যান্ডকে হারিয়েছেন দ্বিগুণ ভোট বেশি পেয়ে। টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি। শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকের বড় মেয়ে।

১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন লন্ডনের মিচামে সেন্ট হেলিয়ার হাসপাতালে। তার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত এবং সিঙ্গাপুরে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিকস, পলিসি ও গভর্নমেন্ট বিষয়ে।

২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে টিউলিপ ব্রিটিশ লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিপরিষদে সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়াবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৭ সালে ব্রিটেনের লেবার পার্টির ছায়া শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক।  ব্রেক্সিট-বিরোধী অবস্থানের কারণে ব্রিটিশ রাজনীতিতে বেশ আলোচিত তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার লন্ডনে আসার বিরুদ্ধে তিনি জনমত গড়ে তুলে মিডিয়ার নজর কাড়েন।

3

ড. রূপা হক : শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ

রূপা আশা হকের জন্ম ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল, লন্ডনের হেমারস্মিথে। তার পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। ১৯৬০ সালের দিকে তার বাবা মুহম্মদ হক পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান। রূপা হক ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ছিলেন।  ১৯৯৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। প্রভাষক হিসেবে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত ছিলেন ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত।  এ ছাড়া লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ট্রিবিউন, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, দ্য টাইমস ম্যাগাজিনের মতো স্বনামধন্য পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোচিত বই সাবকালচার : ইয়ুথ, পপ অ্যান্ড আইডেনটিটি ইন অ্যা পোস্ট কলোনিয়াল ওয়ার্ল্ড। বইটি ২০০৭ সালে ব্রিটিশ সোশিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ফিলিপ আব্রাহাম মেমোরিয়াল পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একজন সাধারণ কর্মী থেকে রাজনৈতিক জীবনের সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত হন। ২০০৪ সালে তিনি ইউরোপিয়ান পার্লমেন্ট নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। ২০০৫ সালে তিনি লেবার পার্টির হয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ টিমের সদস্য হিসেবে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইসলাম’ শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। ২০১০ সালে তিনি লন্ডন বরাহ অব ইলিংয়ের ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে লেবার পার্টি তাকে পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে কনজারভেটিভ পার্টির এমপি অ্যাঞ্জি ব্রে’র বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নমিনেশন দেয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে মাত্র ২৭৪ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে দ্বিতীয় মেয়াদে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। লেবার দলীয় প্রার্থী রূপা হকের প্রাপ্ত ভোট ৩৩ হাজার ৩৭। গতবার মাত্র ২৭৪ ভোটে জয় পাওয়া রূপা এবার জিতেছেন ১৩ হাজার ৮০৭ ভোটের ব্যবধানে।

4

ডলি বেগম : কানাডা পার্লামেন্টের উজ্জ্বল মুখ

৮ জুন২০১৮  কানাডার অন্টারিও প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্কারবরো সাউথওয়েস্ট আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন ডলি বেগম। মৌলভীবাজারের মেয়ে ডলি বেগম মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবা-মা আর ভাইয়ের হাত ধরে কানাডায় যান। টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে উন্নয়ন, প্রশাসন ও পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পড়ালেখা শেষ করার পর সিটি অব টরন্টোতে প্রায় দশ মাস কাজ করেন। এছাড়া  স্কারবরোর হেলথ কোয়ালিশন এবং ওয়ার্ডেন উড্স কমিউনিটি সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করছেন। অন্টারিও প্রাদেশিক ক্যাম্পেইন সমন্বয়ক হিসেবে সরব ছিলেন কিপ হাইড্রো পাবলিক প্রচারাভিযানে। ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়নেরও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অন্টারিও ভলান্টিয়ার সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড, সিটি অব টরন্টো স্পটলাইট, সাউথ এশিয়ান ইয়ুথসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার। যদিও রাজনীতিতে জড়ানোর ভাবনা কখনোই ছিল না তার মনে, তবে গত এক বছর দেশটির নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক দলের স্কারবরো সাউথ আসনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুবাদে এই এলাকার বাসিন্দাদের নানা সমস্যা দেখে এবং দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের আবেদন করেন। অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের ভিড়ে ডলির জন্য স্কারবরো সাউথওয়েস্টের  এই আসনটিতে মনোনয়ন পাওয়া ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ১ লাখ ১০ হাজার ২৮০ জন অধিবাসীর এই এলাকায় ভোটার ছিলেন ৭০ হাজার। ৭ জুন অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ডলি বেগম  প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী গ্রে এলিয়েসকে প্রায় ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ডলির প্রাপ্ত ভোট ১৯ হাজার ৭৫১। কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী গ্রে এলিয়েস পান ১৩ হাজার ৫৯২ ভোট। কানাডার রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কারো এমন সাফল্য এই প্রথম। এবং তার হাত ধরেই ১৫ বছর পর অন্টারিও প্রদেশের স্কারবরো সাউথওয়েস্টে জয় পায় নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads