পৃথিবীর বুকে অস্তিত্বমান মহৎ জাতিগুলো তাদের জাতির পিতা ধারণাটিকে খুব সচেতনভাবেই কোনো ধরনের সংকীর্ণ বািবতণ্ডার সীমায় আবদ্ধ রাখেনি। উদার আকাশের ব্যাপক অভ্রে জাতির পিতা ধারণার প্রতি অকুণ্ঠে তারা মেলে রেখেছে তাদের কৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সেই অবস্থান চির সমুন্নত রাখতে জাতির পিতাদের তারা ধর্ম, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক প্রতিন্যাস, লোকায়ত আচার-আচরণ ও ঐতিহ্যের অমলিন, চিরায়ত সাযুজ্যে স্থাপন করেছে নিজেদের যৌথ মেধা ও মনীষার উদ্ভাবনী প্রয়োগ ঘটিয়ে। কারণ জাতির পিতার পরিচয়েই কোনো জাতির প্রকৃত আভিজাত্যমণ্ডিত পরিচয়। তার শৌর্য-বীর্য-মহত্ত্ব-বীরত্বের প্রতিভাসেই জাতির সামগ্রিক সুবিশাল অবয়বটি গড়ে ওঠে।জাতির পিতার ভাবমূর্তিতে পরিকীর্তিত মার্কিন দেশের জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো মহাপুরুষের সম্মান ও কৌলীন্য রক্ষায় মার্কিন জাতি আর ভারতীয় মহাজাতিসমূহের নানা মত-পথের মানুষগুলোর মধ্যে যে আত্মিক ঐক্য ও আভূমিপ্রণত শ্রদ্ধার প্রকাশ লক্ষ করা যায়, তা আমাদের উপর্যুক্ত ভাবনার পরিসর তৈরি করে দিতে প্রস্তুত।
উল্লিখিত অনুভূতিমালা প্রকাশের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের পরম শ্রদ্ধান্বিত ব্যক্তিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের অভিব্যক্তির প্রকাশ হিসেবে বর্তমান লেখকের কিছু চিন্তন ও অনুভাবনা লিপিবদ্ধ করার খেয়াল। রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সংগঠক, তা থেকে ক্রমে বঙ্গবন্ধু, পরিশেষে জাতির পিতা—এই হিরণ্ময় তকমায় অভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কান্ডারিরূপে শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য জীবনগাথা আমাদের প্রাণিত করে। এই মহান দরদি ও সাহসী কণ্ঠস্বর বহু শতাব্দীর অন্ধকার থেকে আলোর উৎসে এনে দেয় আমাদের। আবার এও সত্য, পরস্পরবিরোধী ভাবাবেগ আর যুক্তির শানিত ধারাস্রোতেও ভাসিয়ে নেয় তার জীবন-আলোচনার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত। তার নামের আগে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধু, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা—এই প্রত্যেকটি অভিধাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে সংখ্যাহীন গবেষণা সন্দর্ভ, চিত্তজয়ী কাব্য, গণগান, অসামান্য গল্পগাথার সমাহার, যুগস্পন্দিত প্রবন্ধ, নাট্যসম্ভার ও চলচ্চিত্র। তার জীবনের কালানুক্রমিক বিবরণে তার মহৎসত্তাকে উন্মোচন করেছেন বহু দেশি-বিদেশি প্রথিতযশা বিদ্বান ও ইতিহাসকার। দেশপ্রেমিক সচেতন গীতরচয়িতারা কথার মাধুর্যে আর নান্দনিক সুরের সারথিরা সুশ্রাব্য ধ্বনির ধৈবতে শতধারায় সুকীর্তিত করেছেন তার অমর নাম। কেননা তিনি চুলচেরা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও আলোচনার অনুপুঙ্খতায় এ ভূভাগের নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালি জাতিসত্তার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির প্রকৃত পথিকৃৎ। তিনিই বিশ্বের বুকে প্রত্ন বাঙালি জাতিধারণার সুস্পষ্ট বাস্তব ও প্রদীপ্ত রূপকার। সমান্তরালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অকুতোভয় ও যশস্বী নির্মাতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম, বেড়ে ওঠা, যৌবনপ্রাপ্তির সময়গুলো ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালখণ্ডের অন্ধ তমসায়। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে অধ্যয়নকালে তার পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তার ভেতরের জাতীয় মুক্তিকামী সত্তাটিকে পরিপূর্ণরূপে উন্মোচিত হবার পরিসর গড়ে দেয়। তখন তিনি ছাত্রসমাজের দিশারিরূপেও সক্রিয়। সময়টা ১৯৪৪-৪৫ সাল। ভারতবর্ষের মাটি থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষচিহ্নটি উপড়ে ফেলে মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এ আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক হিসেবে তার নিজস্ব অনুধাবনা ছিল এরকম : অখণ্ড ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা আমি মনঃপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী; শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ. ৩৬]।
তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশটির নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। সেই সময়ের যুবনেতা শেখ মুজিব এদেরই রাজনৈতিক পথ ও মতে দীক্ষিত ছিলেন। মুসলিম লীগের এই প্রগতিশীল দাপুটে অংশের দূরদর্শী রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা প্রস্ফুটিত হয় বঙ্গবন্ধুর আরো একটি উক্তিতে। সেই উক্তির কিয়দংশ এখানে উদ্ধার করা যাক : মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খানসাহেব, খানবাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণির লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতো না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খানবাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল।... (ঐ, পৃ. ৩৫)।
যে পাকিস্তান বানাতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি সবিশেষ পর্ব নিরলসভাবে ব্যয়িত হয়েছিল, সেটির পেছনে ছিল ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বাংলার আরেক শার্দূল এ কে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের এই মর্মবাণী, যেখানে বলা হয় :
...that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India should be grouped to constitute `independent states’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা ওই সম্ভাব্য ক্ষমতাকেন্দ্র আপাত অপহূত হলেও লাহোর প্রস্তাবের সুদূরপ্রসারী চেতনার ধারণ ও বাস্তবায়ন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক সাথি-সারথিরা। তারই সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এলো ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে প্রকৃষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষণগুলো। পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক পথরেখা জ্বলজ্বলে অক্ষরে যা খোদিত করে রেখেছে। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও লেখক কামরুদ্দীন আহ্মদের ভাষায় : ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাকে সরকারি ভাষায় উন্নীত করার গতিবেগ বর্ধিত হলো। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো, তা বাংলা ভাষার দাবিকে দিল আরো সুস্পষ্ট রূপ, বাংলাকে গ্রহণ করতে হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে, এই হলো তাদের বক্তব্য। ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট আর বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হলো। ১২ তারিখের বিক্ষোভ প্রদর্শন আরো অধিক তীব্র আকার ধারণ করল এবং ১৪ তারিখে দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রদেশে। খাজা নাজিমুদ্দিন ভীত হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমন এই ভীতির একটা বিশেষ কারণ ছিল। স্বাধীনতা লাভের পর এটাই ছিল তার প্রথম এবং শেষবারের মতো ঢাকা আগমন। নাজিমুদ্দিন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের কাছে আপসের জন্য পাঠালেন। সংগ্রাম পরিষদ ফজলুল হক হল মুসলিম ছাত্রাবাসে তাদের দাবি প্রণয়নের জন্য মিলিত হলো।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিপ্রায় ছিল আলাপ-আলোচনার সময় চিফ সেক্রেটারি উপস্থিত থাকবেন; কিন্তু তিনি তাতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী সব দাবিই মেনে নিলেন এবং পরদিন ১১টা ৩০ মিনিটের সময় তিনি এবং সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক চুক্তিনামায় স্বাক্ষরদান করলেন। অতঃপর ঢাকা জেলে অবরুদ্ধ নেতৃস্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য আহ্বায়ককে অনুমতি দেওয়া হলো। বাংলাকে সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব বিধানসভায় উত্থাপন করলেন নাজিমুদ্দিন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। ১৫ তারিখে সূর্যাস্তের পূর্বেই কারার অন্তরালে অবরুদ্ধ সমস্ত রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হলো এবং সংবাদপত্রগুলোর ওপর থেকে প্রত্যাহার করা হলো সমস্ত নিষেধাজ্ঞা। জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে লাগল স্বাভাবিকতা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জিন্নাহ সাহেব সম্ভবত অবাঙালি সেক্রেটারিদের পরামর্শমতো চুক্তির শর্তগুলোকে অস্বীকার করে বসলেন এবং ঢাকার ঘোড়দৌড় ময়দানের জনসভায় তিনি ঘোষণা করলেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এতে একদল লোক সে সভা থেকে প্রতিবাদ করে বের হয়ে গেল। বাঙালি মানসে এত বড় আঘাত লাগল আর ছাত্ররা এত ক্রুদ্ধ হলো যে, তারা সমস্ত শিক্ষায়তন থেকে তার ছবি অপসারণ করল। ঐতিহ্যবাহী ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জিন্নাহ সাহেবকে জোর গলায় জানিয়ে দিল—ভাষা সম্পর্কে যদি তার মত পরিবর্তন না হয়, তাহলে তারা তাকে তাদের সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করতে অস্বীকার করবে। জিন্নাহ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সমাবর্তন বক্তৃতায় পুনরায় উচ্চারণ করলেন তার সেই পূর্ব উক্তি, আর সঙ্গে সঙ্গে সভায় শুরু হলো এক ভীষণ গোলযোগ। ফলে বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখেই তিনি সভাকক্ষ থেকে চলে গেলেন। এরপর সংঘটিত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা।
এক কথা সত্য, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন মাত্রায় অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে অনন্যসাধারণ কর্মযোগীর ভূমিকা রেখেও পরবর্তীসময়ে ওই রাষ্ট্রের ভেতরকার ভেদমূলক ও কদর্য সাম্প্রদায়িক কলকবজার মরচের সঙ্গে জড়িয়ে না গিয়ে দূরদর্শী রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রজ্ঞায় জাতির জন্য অভ্রান্ত পথরেখা নির্ণয় করেছিলেন। সত্য বটে ইতিহাসের নিষ্ঠুর ও বঙ্কিম ভ্রুভঙ্গির নির্দেশে সেকালের অগ্রগণ্য মুসলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সমান্তরালে তাকেও পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম তরুণ স্বাপ্নিকরূপে পাওয়া গেছে। কারণ ভারত ভাগের অনিবার্য ডামাডোলে সেকালের জাজ্বল্যমান বাস্তবতার আলোকে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ বা ভূখণ্ডের প্রয়োজনীয়তা ছিল তর্কাতীতভাবেই সত্য। এই বাস্তবতার ভেতরের আরো গভীর বাস্তবতা ছিল লাহোর প্রস্তাবের সেই ধারা, যেখানে ছিল ‘স্বায়ত্তশাসিত’ প্রদেশসমূহ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার ইঙ্গিত। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আপাতভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অতি অবশ্যই শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আবার দেখা গেল, সেই রাষ্ট্রটি গঠিত হওয়ার পর দ্রুতই মোহভঙ্গ হতে থাকে তৎকালীন পূর্ববাংলার সচেতন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও জনসমাজের। যে প্রত্যাশা নিয়ে ওই রাষ্ট্র নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই রাষ্ট্রের সূচনাতেই তারা দেখল, রাষ্ট্রভাষাকেন্দ্রিক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার শনৈ শনৈ উন্মেষ ঘটে চলেছে। এই চেতনাধারাই ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনের নামে শোষণ ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিকে দিনদিন ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর করে তোলে। এই বিক্ষুব্ধতার অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সুস্পষ্ট নেতৃত্বে চলে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রখর ইতিহাসবোধ, তেজস্বী জনজাগরণী অভিভাষণসমূহ, সঠিক রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণের জাদুকরী গুণ, পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনের গভীরতলে ডুব দিয়ে তাদের চাওয়া-পাওয়ার নিবিড় আবেদন উপলব্ধির অসাধারণ ক্ষমতা তাকে তার কালের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে তিনি যে ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপন করলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে তা যে লাহোর প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত চেতনার আলোকে সেটি অনুধাবনে সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র কালক্ষয় হলো না। অন্যদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই ছয় দফাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আইন ও বিধি-বিধানের সমান্তরালে জনসাধারণের আইন ও বিধি-বিধানে রূপান্তরিত হলো। ১৯৬৯ সালের মধ্যে বাঁধভাঙা জাগরণ চূড়ান্তভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি নাড়িয়ে দিল। আর পরবর্তীসময়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব প্রবলভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আরো জনপদের আনাচ-কানাচে। সকল কণ্ঠের ঊর্ধ্বে ওই কণ্ঠের পরাক্রান্ত অবস্থান জনসাধারণকে তার অভ্রান্ত নেতৃত্বের প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী ও আস্থাশীল করে তোলে। আর সেই আস্থাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিপক্ষে নতুন রাষ্ট্র গঠনের শক্তিমত্ত ভ্রূণ প্রথিত করে প্রত্যেক বাঙালির মস্তিষ্কের কোষে কোষে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকারের মুক্তিদাতা নেলসন ম্যান্ডেলার (১৯১৮-২০১৩) নামের শেষাংশ ছিল ‘রোলিহলাহলা’। এই আফ্রিকীয় শব্দটার ইংরেজি অর্থ ‘ট্রাবলমেকার’। কী অদ্ভুত তাৎপর্যপূর্ণ নাম! তিনি তো আসলেই (সম্পূর্ণ ইতিবাচক অর্থে) ছিলেন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক ও কালো মানুষের মানবাধিকার দলনকারী অপকর্মের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই তাদের শয়নের আনন্দ হারাম করে দেওয়া ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’ এক সার্বক্ষণিক আতঙ্ক বিশেষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও বাঙালি জাতির প্রতি জাতিতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে বৈষম্যপোষণকারী পাকিস্তান রাষ্ট্রচালকদের বিরুদ্ধে ছিলেন সেই এক ‘ট্রাবলমেকার’।
শোষক ও বঞ্চনাসৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে যে ‘সংকট সৃষ্টিকারী’ তার জাতির জন্য নিয়ে আসে অনাবিল স্বাধীনতা ও মুক্তির পরিপূর্ণ পার্থিব আনন্দ।
লেখক : কবি, সাংবাদিক