যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ

  • প্রকাশিত ৮ মে, ২০২১

নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথ গ্রহণের পরপর ঘোষণা দিলেন, তারা আফগানিস্তানকে নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চান না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পথেই হাঁটতে আগ্রহী নতুন প্রেসিডেন্ট। ২০০১ সালে শুরু হওয়া দীর্ঘ এ যুদ্ধে আমেরিকার বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। উল্টো ধারণা করা হয়, আমেরিকার খরচ হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ। নিহত হয়েছে ৩৫০০ আমেরিকান সৈন্য এবং ২ লক্ষ নিরীহ মানুষ। যে আমেরিকা তালেবানদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করেছিল তারা আবার তালেবানদের সঙ্গেই এক টেবিলে বৈঠক করে শান্তিচুক্তিতে একমত হলো। এবার দেখা যাক, আমেরিকা চলে গেলে তাদের কোলে থাকা আশরাফ গনির আমেরিকাপন্থি সরকার এবং তালেবানদের ভবিষ্যত কী হয়। আফগানিস্তান কি পারবে শান্তির পথে হাঁটতে? নাকি প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের ছায়াযুদ্ধের ময়দান তৈরি হবে দেশটিতে? হতে পারে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। কী হবে আফগানিস্তানের পরিণতি? 

সময়টা ২০০১ সাল। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে ওসামা বিন লাদেনের নির্দেশে আত্মাতী বিমান হামলা করে আল-কায়েদা।  সেই হামলায় বহু মার্কিনি নিহত হয়। এই হামলার জের ধরে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নির্দেশে আমেরিকা ও ন্যাটো জোট আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণ করে। একসময়ের আমেরিকার হাতে গড়া তালেবান তখন আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায়। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর কাবুল, কান্দাহার এই প্রধান দুটি শহরে আক্রমণ করে আমেরিকা এবং ন্যাটো জোট। আমেরিকার ভারী অস্ত্রের মুখে তালেবান সরকার বেশি দিন টিকতে পারে না। তালেবানরা পিছু হটে। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে আমেরিকার মদতপুষ্ট সরকার। কিন্তু তালেবানরা সাময়িক পিছু হটলেও তারা দমে যায়নি। তারা তাদের মতো যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তালেবানরা পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের বিদ্রোহ চালিয়ে যায়। তারা একের পর এক আত্নঘাতী হামলা, রোডসাইড বম্বিং, চোরাগোপ্তা হামলা এবং শহরাঞ্চলে ভয়াবহ হামলা অব্যাহত রাখে। আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে সাহায্য করে আসছে আমেরিকা। তারা অস্ত্র এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাহায্য করে আসছে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীকে। তালেবানরা আমেরিকার সৈন্য এবং আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীকে মোকাবিলা করে আসছে দীর্ঘ ২০ বছর। বিপুল অস্ত্র, বোমা মেরে তারা তালেবানদের সাময়িক পিছু হটাতে পেরেছিল ঠিকই; কিন্তু তাদের গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি। উল্টো আফগানিস্তানের প্রায় অধিকাংশ এলাকা তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আফগানিস্তানে এখন যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, আমেরিকার সেনাদের নিজ দেশে ফেরাবেই তার সরকার। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন পহেলা মে’র মধ্যে সেনা সরানোর সিদ্ধান্ত নিলেও অনেকে মনে করতেন বাইডেন ট্রাম্পের নীতি গ্রহণ করবেন না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাইডেন একই পথে হাঁটলেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারে আমেরিকা ও তালেবানদের চুক্তি হওয়ার পর অদ্ভুতভাবে আফগানিস্তানে হামলা বেড়ে যায়। তালেবানরা এই হামলাগুলোর দায় স্বীকার করেনি। তাহলে কারা হামলা করছে? আফগানিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের। আফগানিস্তানের আমেরিকাপন্থি আশরাফ গনির সরকারের সঙ্গে রয়েছে ভারতের ব্যাপক সম্পর্ক। ভারত আফগানিস্তানে অনেক বিনিয়োগ করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের একমাত্র দাবিদার ভারত। অন্যদিকে তালেবানঘেঁষা পাকিস্তান এদিকে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তালেবানরা যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন করার সম্ভাবনা ৯০ ভাগ। আমেরিকা ও ন্যাটো জোট যদি আফগানিস্তান ছাড়ে, তাহলে এটি পাকিস্তানের জন্য বড় সুখবর বয়ে আনবে তা ভারত জানে। তাই অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আফগানিস্তানের গত কয়েকদিনের হামলার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। তবে এ কথার সাপেক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। বর্তমানে আফগানিস্তানের ৬০-৬৫ ভাগ এলাকা তালেবানদের দখলে। আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের ক্ষমতা যে তালেবানরা নিতে চাইবে এটি সবারই জানা। তালেবানদের মোকাবিলা করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য আফগানিস্তান সরকার আশরাফ গনির নেই। 

যদি আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে যাওয়ার আগে একটি সর্বজনস্বীকৃত সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে বলা যায় আমেরিকার প্রস্থান আফগানিস্তানের জন্য সার্থক হবে। যদি আমেরিকা আফগানিস্তানে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয় এবং তারা চলে যায়, তাহলে আশরাফ গনি এবং তার সরকারকে তালেবানদের দয়ার ওপরই ছেড়ে যেতে হবে। তালেবানরা অবশ্যই তাদের অতীত ইতিহাসের প্রতিশোধ নিতে চাইবে। আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে হলে আমেরিকার দরকার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। উভয়পক্ষের মধ্যে দরকার একটি কার্যকর শান্তিচুক্তি। অনেকে বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আমেরিকার প্রস্থান মানে আফগানিস্তানকে আরেকটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া। আফগানিস্তানে এখনো বেশ ভালো অবস্থানে আছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আমেরিকার আফগান ছাড়া মানে আইএস-এর পুনরুত্থান হবে বলে অনেকে মনে করেন। তাই আফগান সরকার এবং তালেবান উভয় পক্ষ নিয়ে একটি স্বর্বজনস্বীকৃত সরকার গঠন করা একান্ত প্রয়োজন। এ ছাড়া আমেরিকার প্রস্থান মানে আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও ভারতের ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া। আফগানিস্তানের হাতে ক্ষমতা গ্রহণ মানে ভারতের বিনিয়োগগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া। প্রতিবেশী চীনও যে এই ছায়াযুদ্ধে অংশ নিতে মরিয়া তা নিশ্চিত।

সম্প্রতি চীনও আফগানিস্তানে বিনিয়োগে মরিয়া হতে পারে। আর তা একটি বড় রকমের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তালেবানও আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। একমাত্র আমেরিকান সৈন্য চলে যাওয়ার শর্তে তারা শান্তি আলোচনায় বসেছিল। আফগানিস্তানের নিরীহ শান্তিকামী জনগণ সবসময় শান্তি চেয়ে আসছে। আমেরিকা ও ন্যাটো জোট তাদের দেশে ঢোকার আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) আফগানিস্তানে ছিল। তখন তালেবানরাই ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটিয়ে তাদের দেশ বৈদেশিক সেনা মুক্ত করে। তার কিছুদিন পরেই নাইন ইলিভেনের হামলার জের ধরে আমেরিকা ও তার ন্যাটো জোট আসে আফগানিস্তানে। মুহূর্তেই দেশটিতে ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের যুদ্ধমুক্ত একটি দেশের স্বাদ অনেক দিনের। তারা বহু প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে আমেরিকার ও তালেবানদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতার দিকে।

লেখক :খালিকুজ্জামান জুন

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads