নদীমাতৃক দেশটায় জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নদী। নদী আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অবিচ্ছেদ্যভাবে। নদীকেন্দ্রিক দেশ হওয়ায় নৌপথ একটা জনপ্রিয় জনপথ বলে গণ্য সাধারণ মানুষের কাছে। বাণিজ্যিক কারণে অনেক আগে থেকেই নৌপথের জনপ্রিয়তা রয়েছে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাধান্য পেয়েছে বেশ আগে থেকেই। এর কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে-দ্রুত গন্ত্যব্য স্থানে পৌঁছানোর সুবিধা, প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগসহ বেশ কিছু কারণ। নৌপথ ব্যবহারের অন্যতম কারণের মধ্যে একটি হলো অনেক অঞ্চলের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হওয়া। একমাত্র বললে ভুল হবে, এক কথায় সহজ পথ হওয়ায়।
কিন্তু নৌপথ যেন এখন মৃত্যুকূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকদিনের ব্যবধানেই নতুন নৌদুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়। বাতাসে ভাসে প্রিয়জন হারানোর বিষাদমাখা হাহাকার। ফুটফুটে তাজা প্রাণগুলো হেরে যায় জীবনের কাছে। নৌদুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে আছে-অতিরিক্ত যাত্রী কিংবা মালামাল বহন করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেটের ঘাটতি, অসচেতন ও অনভিজ্ঞ চালক, লাইসেন্সবিহীন নৌযান, ক্ষতিগ্রস্ত নৌযান ব্যবহার, নদীতে চর পড়ায় মাটির সঙ্গে ধাক্কা প্রভৃতি।
বর্ষা মৌসুমে নদীতে স্রোত বেশি থাকায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। অনেক সময় ভুল রুটে চলাচলের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বর্ষা মৌসুমে অন্য সময়ের চেয়ে নৌদুর্ঘটনার পরিমাণটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তা ছাড়া নৌদুর্ঘটনার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করা হয়, কিন্তু পরিসংখ্যান বলে মোট নৌদুর্ঘটনার ২৩.৬০ শতাংশ হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তথা ঝড়, বৃষ্টি, জোয়ার-ভাটা কিংবা বৈরী আবহাওয়ার জন্য। আর প্রায় ৭০ শতাংশ নৌদুর্ঘটনা ঘটছে শুকনো মৌসুমে। তাহলে বুঝতে হবে নৌদুর্ঘটনার অন্যতম কারণ আইন ভঙ্গ ও অসচেতনতা।
সম্প্রতি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাংলাবাজার ফেরিঘাটে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে একটি স্পিড বোর্ডের সংঘর্ষ ঘটে। এ দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। যে স্পিড বোর্ডের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ১০-১২ জন সেখানে ৩০ জনের উপরে যাত্রী ছিল। উপরন্তু ছিল না পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, যার জন্য প্রাণহানি ঘটেছে আরো বেশি। এমন দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু লকডাউনে যেখানে সবকিছু বন্ধ, এমনকি স্পিডবোট চলাচলও বন্ধ, সেখানে কীভাবে এতগুলো যাত্রী নিয়ে একটি স্পিডবোট চলে! এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রায়ই সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাত্রী কিংবা মালামাল বহনের জন্য মর্মান্তিক দুর্ঘটনার স্বীকার হতে হয়, জীবন বলি দিতে হয় নিমিষেই। হোক সেটা বাড়তি টাকা উপার্জনের লক্ষ্যে কিংবা যাত্রীর চাপে। কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীর অসাবধানতার জন্যও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এর আগে গত এপ্রিল মাসে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৫ জন যাত্রীর প্রাণ যায়। কার্গোর ধাক্কাতে লঞ্চটি ডুবে যায়। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জানা যায় কার্গোটি লঞ্চের সামনে এসে হর্নও দেয়নি। লঞ্চটি ডুবে যাওয়াতে কার্গো চালকের দায় এড়ানোর কোনো উপায় নেই। এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে— তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর ত্রুটি সম্পর্কে। সেতুর নকশায় ত্রুটি থাকার প্রভাব পড়েছে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ৫৭০টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৫৪ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় ৫১৬ জন আহত ও ৪৮৯ জন নিখোঁজ হন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা ২৩৬টি। ২০১৯ সালে ২৬টি নৌদুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। ৩৩ জন আহত ও ২০ জন নিখোঁজ হন। এর আগে ২০১৫ সালে ২২টি দুর্ঘটনায় ১২০ জন মারা যান। অন্যদিকে ‘জাতীয় নৌনিরাপত্তা সপ্তাহ-২০১৭’ উপলক্ষে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি ৫০ বছরে নৌদুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশের প্রতিবেদনে জানা যায়, ৫০ বছরে দেশে নৌদুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২০ হাজার ৫০৮ জন। সম্পদের ক্ষতি হয় ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। দীর্ঘ এ সময়ে দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭২। এর মধ্যে ৯০১টি নৌযান কোনোদিনই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গত ১২ বছরের মধ্যে ২০০৭ সালে নৌদুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, যার সংখ্যা ২ হাজার ১৭৭ জন।
এমন বড় বড় দুর্ঘটনা ছাড়া ছোটো খাটো দুর্ঘটনা নৌপথে লেগেই থাকে। নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ও ধরন অনুযায়ী শুধু সংঘর্ষে ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত যাত্রী বা মাল বোঝাইয়ের কারণে ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং অন্যসব কারণে ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। আর সংঘর্ষের বেশিরভাগ ঘটনার সঙ্গে মানুষ জড়িত।
নৌপথে দুর্ঘটনা হওয়ার ও দুর্ঘটনা না কমার কারণের মধ্যে অন্যতম হলো প্রশাসনের গাফিলতি। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশের একমাত্র নৌ-আদালতে মামলা ঝুলছে প্রায় ১৬০০টি। মামলা হলেও বিচার না হওয়ার কারণের মধ্যে আছে রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতা কিংবা সাক্ষী হাজির করতে না পারা। তবে এই দায় এড়াতে পারবে না দেশের সর্বোচ্চ আদালত। লঞ্চ ও নৌদুর্ঘটনার ১৮টি মামলা এখনো নৌ-আদালতে চলমান। কিন্তু এর সুরাহা মিলবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
মোদ্দাকথা, জনগণ চায় নৌপথের নিরাপদ যাত্রা। এ ক্ষেত্রে দরকার সচেতনতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলে কোনোভাবে নৌচলাচল চালু রাখা যাবে না। অতিরিক্ত যাত্রী কিংবা মালামাল না নেওয়া। দক্ষ চালকের ব্যবস্থা করা, লাইসেন্সবিহীন নৌযান বয়কট ও জরিমানা করতে হবে। পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেটের সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে এবং নৌ আদালতের প্রণয়নকৃত আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। অনেক সময় দুর্ঘটনার মূল নৌযানের মালিক প্রভাবশালী হলে সেই মামলা থেমে যায়। কিন্তু নৌপথে সুরক্ষা পেতে চাইলে এসব মামলার বিচার করা বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া নৌপথে দুর্ঘটনা এড়াতে যাত্রীসহ সরকারি-বেসরকারিভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। এসব বাস্তবায়ন হলেই ধীরে ধীরে বিলীন হবে নৌদুর্ঘটনা। নৌযাত্রা হবে শান্তিপূর্ণ।
লেখক :বিশাল সাহা
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা