মুফতি কাজী সিকান্দার
পৃথিবীর বুকে সব প্রাণির একটি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষেরও বিভিন্ন লক্ষ্য রয়েছে। তবে যারা মুসলিম, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যারা দিন-রাত সিজদায় লুটিয়ে পড়ে, যারা শত কষ্ট করেও আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজেদের স্বাদ ইচ্ছাকে বিলীন করে। তাদের একটি মাত্র লক্ষ্য, তাদের একটি মাত্র চাওয়া, তাদের একটিই আশা-যেন আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তাদেরকে যেন কবুল করেন। আল্লাহ তাদের ওপর যেন রাজি হয়ে যান। এ লক্ষ্যেই সব চেষ্টা ও মুজাহাদা করে মুসলমান। আল্লাহর সবকিছুই মেনে নেয় তারা। তাদের ধ্যানে, জ্ঞানে, ভাব ও ভাবনায় থাকে খোদা। তারা চায় শুধু তাঁর ভালোবাসা। আল্লাহতায়ালাও বিশেষ কিছু বান্দাকে ভালোবাসেন।
সবরকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন : বান্দা বড় অধৈর্য। তাড়াতাড়ি যেন সব হয়ে যায়। সফলতা যেন সব দ্রুত দেখা দেয়। তাই বান্দা ছটফট করে। বান্দা অতি বেশি ছটফট করবে সেটা আল্লাহ জানেন তাই আল্লাহ তার বন্দাকে সবরের সবক শিক্ষা দিচ্ছেন-এতেই সফলতা। আল্লাহ বলেন, আর বহু নবী ছিলেন, যাঁদের সাথী-সঙ্গীরা তাঁদের অনুবর্তী হয়ে জিহাদ করেছে। আল্লাহর পথে তাদের কিছু কষ্ট হয়ছে বটে, কিন্তু আল্লাহর রাহে হেরেও যাননি, ক্লান্তও হননি এবং দমেও যাননি। আর যারা সবর করে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।(আলে ইমরান- ১৪৬)
তাওয়াক্কুলকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন : আমাদের সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। আমাদের লালন-পালনকারী আল্লাহ। তাই আমাদের ভরসার একমাত্র আল্লাহর ওপরই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি না। অথচ যদি আমরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি তবে আল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসবেন। ইরশাদ হয়েছে“‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও অনুগ্রহের কারণে তুমি তাদের প্রতি নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাব এবং কঠিন হূদয়সম্পন্ন হতে তবে তারা তোমার কাছ থেকে সরে যেত। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন ইচ্ছা করবে তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন। (আলে ইমরান-১৫৯)
মুত্তাকীদের আল্লাহ ভালোবাসেন : তাকওয়া অবলম্বন যদি নাই হয় তবে এ জীবনই যেন বৃথা। তাকওয়া হলো আল্লাহর ভয়, আল্লাহকে ভয় করে প্রত্যেক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। যদি আমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারি তবে আল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসবেন। আল্লাহ বলেন, ‘হ্যাঁ অবশ্যই যে ব্যক্তি স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।’ (আলে ইমরান-৭৬)
তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন : আমাদের পাপের সীমা নেই। তবে আমরা যত পাপই করিনা কেন অন্যের হক নষ্ট ছাড়া সব পাপই আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন তাওবার বদৌলতে। তাওবার মাধ্যমে মানুষ পবিত্র হয় গুনাহ থেকে। তাই আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।’ (সুরা বাকারা-২২২)
অনুগ্রহকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন : আল্লাহ নিজে অনুগ্রহকারী। তাই যে ব্যক্তি অনুগ্রহ করে আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। দয়া করা, দান-সদকা করা, অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া, অন্যের দুখে দুখি হওয়া, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়াই হলো অনুগ্রহ করা। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর পথে দান-সদকা করো এবং নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা-১৯৫)
আল্লাহর পথে জিহাদকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন : আল্লাহ বান্দাকে পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বানিয়েছেন। দিনকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধ হয়ে এমনভাবে জিহাদ করে, যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।’ (সুরা সাফ-০৪)
যাকে আল্লাহ ভালোবাসেন তাকে পৃথিবীও ভালোবাসেন। যদি কোনো বান্দা তার কাজের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করতে পারে তবে তাকে যেমন আল্লাহ ভালোবাসবেন তেমনি সব মাখলুক তাকে ভালোবাসবে। সে পৃথিবীর ভালোবাসার পাত্র হয়ে যাবে। মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিবরাঈল (আ.) কে ডেকে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, অতএব তুমিও তাকে ভালোবাস। তখন জিবরাঈল (আ.)ও তাকে ভালোবাসেন। এরপর হজরত জিবরাঈল (আ.) আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন আসমানবাসীও তাকে ভালোবাসতে থাকে। এরপর পৃথিবীতেও তাকে গ্রহণ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। (বুখারি-২৯৮২) আল্লাহকে আমরা কীভাবে ভালোবাসবো তা আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন-(হে নবী) বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুকরণ করো, তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবে এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দায়ালু। (ইমরান-৩১)। আমরা সবাই আল্লাহকে ভালোবাসি এ কথা বাস্তবে প্রমাণ হবে যদি আমরা আমাদের জীবনে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহকে অনুসরণ করি। আর সুন্নাহ অনুসরণে তিনটি জিনিস পাওয়া যাবে। এক. আমরা যে আল্লাহকে ভালোবাসি তার প্রমাণ হবে। দুই. আল্লাহও আমাদেরকে ভালোবাসবেন। তিন. আল্লাহ আমাদের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, আশরাফাবাদ, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা