মোনেম মুন্না : বাংলাদেশের ফুটবল সেলিব্রেটি

বাংলাদেশ ফুটবল দলের কাণ্ডারির ভূমিকায় ছিলেন দীর্ঘদিন

ছবি : সংরক্ষিত

ফিচার

মোনেম মুন্না : বাংলাদেশের ফুটবল সেলিব্রেটি

  • ফারজানা ইয়াসমিন
  • প্রকাশিত ২৫ জুন, ২০১৮

১৯৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের বিরুদ্ধে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা দল। জেলা দলের হয়ে মাঠের দর্শক থেকে শুরু করে জাতীয় দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দেরও চমকে দিয়েছিল সেদিন মাত্র ১৪ বছরের বালক মুন্না। খেলা শেষে বাফুফের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, এই ছেলে এই বয়সেই জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে।

‘কিং ব্যাক’ খ্যাত মোনেম মুন্না সম্পর্কে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের একসময়কার জার্মান কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন, ‘তার জন্ম ভুলবশত বাংলাদেশে হয়েছে।’ বাংলাদেশে জন্ম হওয়ার কারণেই বহির্বিশ্ব মুন্নার প্রতিভার স্ফুরণ দেখতে পারেনি বলে প্রায়ই আক্ষেপ করতেন ফিস্টার। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন বলে গণ্য করা হয় তাকে। তার হাত ধরে ফুটবলের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ একাধিক সাফল্য পেয়েছিল। নিজের প্রতি তার এমনই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, তিনি বিশ্বাস করতেন, তাকে ড্রিবল কিংবা পরাস্ত করে কোনো স্ট্রাইকার পার হতে পারবে না। তার শক্তিশালী ট্যাকলের স্বাদ পায়নি, এমন ফরোয়ার্ড পাওয়া ঢাকার মাঠে খুবই দুষ্কর। দক্ষ নেতৃত্ব এবং দুর্দান্ত পেশাদারিত্বের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে উপমহাদেশের জনপ্রিয় ফুটবল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৬৮ সালের ৯ জুন নারায়ণগঞ্জে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি ছিল তার ভীষণ ঝোঁক। ১৯৮০-৮১ সালে পাইওনিয়ার ডিভিশনে গুলশান ক্লাবের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে মুন্নার অভিষেক ঘটে। পরের বছর যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগরে। ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুন্নাকে দলে নেয়। এ বছরই দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উঠে আসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। ১৯৮৬ সালে তিনি এক মৌসুমের জন্য চলে যান ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ব্রাদার্সের হয়ে তার দুরন্ত পারফরম্যান্স নজর কাড়ে আবাহনী কর্মকর্তাদের। ১৯৮৭ সালে যোগ দেন ঢাকার ক্লাব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। এ সময় আবাহনীর হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছিলেন আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম রাব্বানী হেলাল, আসলামের মতো তুখোড় সব ফুটবলার। তরুণ মুন্না তার পারফরম্যান্স দিয়ে সবার মধ্যে নিজের জায়গা পাকা করে নেন। এরপর তিনি আর কখনো দল পরিবর্তন করেননি। আবাহনীই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। আবাহনীর ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে দলবদলে মুন্না আবাহনীর হয়ে রেকর্ড পারিশ্রমিক পান, যা ছিল সে সময়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অনন্য রেকর্ড। আবাহনীর হয়ে মুন্না তার ফুটবল ক্যারিয়ারে দলকে পাঁচবার ঢাকা লিগ এবং তিনবার ফেডারেশন কাপের শিরোপা জেতাতে সক্ষম হন। ১৯৯০ সালে আবাহনীর সব ফুটবলার চড়া দামে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে নাম লেখালেও দলের প্রতি ভালোবাসায় একাই আবাহনীতে থেকে যান মুন্না। সে বছরই একদল তরুণ ফুটবলারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে লিগ শিরোপা জিতিয়ে আনেন।

আবাহনীর হয়ে খেলতে খেলতে মুন্না নাম লেখান ভারতের স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলে। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে ইস্ট বেঙ্গলকে লিগ শিরোপা এবং ফেডারেশন কাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মুন্না। এ সময় ইস্ট বেঙ্গল সমর্থক এবং ফুটবলপ্রিয় বাঙালিদের মন জয় করে নেন তিনি। ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছিলেন, ‘মুন্না একজন শক্তিশালী ডিফেন্ডার, একজন দারুণ ট্যাকলার এবং হেডার।’ ইস্ট বেঙ্গলের ক্লাব অফিসিয়াল দেবব্রত সরকার বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশে মুন্নার মতো দ্বিতীয় আর একজন জন্মাবে না।’ ভারতে বাংলাদেশের ফুটবলের এক অনবদ্য বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছিলেন মুন্না। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের ‘হল অব ফেম’-এ মুন্নাকে জায়গা দিতে দুবার চিন্তা করতে হয়নি ক্লাবটিকে।

জনপ্রিয়তা এবং পারফরম্যান্সের জন্য নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে করপোরেট বাণিজ্যের প্রধান আইকন হয়ে ওঠেন মোনেম মুন্না। বিশ্বখ্যাত প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার ১৯৯৬ সালে মুন্নাকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে।

১৯৯৭ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর ম্যানেজার হিসেবে প্রিয় ক্লাব আবাহনীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। ২০০০ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলেও ২০০৪ সালে তার দেহে ক্ষতিকর ভাইরাস ধরা পড়ে। ২০০৫ সালের ২৬ জানুয়ারি গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ ফুটবলের আইকন মোনেম মুন্না।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads