ডা. অমৃত লাল হালদার
শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প কিছু নেই। মায়ের বুকের দুধ এমন একটি জিনিস যার কোনো খারাপ দিক নেই। কিন্তু বুকের দুধ নিয়ে আমাদের রয়েছে নানা ধরনের ভুল ধারণা ও কুসংস্কার। যার ফলে মায়ের ওপর চলে আসে নানারকম নিষেধাজ্ঞা। এরকম কিছু ভুল ধারণা সবার সঙ্গে শেয়ার করব :
· অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে বিশেষ করে নতুন মায়েরা এমনিতেই উদ্বিগ্ন আর অস্থির হয়ে থাকেন। বাচ্চা একটু কান্না করলেই মনে হয় যে, তাদের সন্তান ঠিক মতো দুধ পাচ্ছে না। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। ক্ষুধা ছাড়াও কান্না করার আরো অনেক কারণ রয়েছে। শুধু লক্ষ রাখুন, ওজন বাড়ছে কি-না আর দিনরাত মিলিয়ে ছয়বার বা তার বেশি প্রস্রাব করে কি-না।
· শালদুধ হলো শিশুর প্রথম খাবার এবং প্রথম টিকা। তাই শালদুধ খাওয়ানো উচিত নয়, এটা ফেলে দিতে হবে- এমন প্রচলিত কুসংস্কার খুবই ভয়ংকর। শালদুধে প্রচুর প্রোটিন ও ভিটামিন এবং এমনসব উপাদান আছে যা রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
· বুকের দুধ না দিয়ে মধু, মিছরির পানি, শরবত বা গ্লুকোজের পানি দেওয়া বিপজ্জনক। এতে শিশুর ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। আদর্শ কাজ হলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবং অবশ্যই এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো।
· অনেকেই মনে করে মা ঝাল-মশলা দিয়ে খাবার খেলে শিশুর নাকি পেটব্যথা হবে, গ্যাস হবে। আবার অনেকের ধারণা, ঘি ও সুজি খেলে মায়ের বুকে বেশি দুধ হবে; তবে ডাল, মটরশুটি জাতীয় খাবার চলবে না- এ ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মা ঝাল-মশলা, চায়নিজ, দেশি যে কোনো খাবারই খেতে পারেন।
· মায়ের বুকের দুধের সঙ্গে উপরি, আলগা, তোলা দুধ কিংবা সুজি বা এ-জাতীয় খাবার দিলে বাচ্চার পুষ্টি ও স্বাস্থ্য ভালো হবে এমন ধারণা রয়েছে অনেকের। আসলে মায়ের বুকের দুধ এমনই এক সুষম খাদ্য যা প্রথম ৬ মাস খাওয়ালে সে সময়ে অন্য কোনো খাবার, পানীয়, মধু, চালের গুঁড়ার, সুজি, চিনির পানি, এমনকি সাধারণ পানি- কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। বিদেশি নামিদামি বেবি ফুড খেলে শিশুর পুষ্টি বেশি হবে এমন অপধারণাও কাউকে কাউকে প্রলুব্ধ করে।
· অনেকে আবার মনে করেন সিজারিয়ান অপারেশন করালে বুকের দুধ দেওয়া যাবে না। এটাও একেবারে ভুল ধারণা। অপারেশনের পর পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাকে সহজেই বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।
· বুকে দুধ কম এলে অনেক ক্ষেত্রে মাকে ‘অপয়া’ হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়। এ ধরনের অপবাদে মা মানসিকভাবে আরো বেশি ভেঙে পড়েন এবং এই মানসিক সমস্যাই মায়ের বুকে দুধ না আসার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মনে রাখতে হবে, বাচ্চা জন্মগ্রহণের পর দুধ আসা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং মায়ের পুষ্টি যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দুধ আসবে। বরং অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম এবং মানসিক অশান্তি মায়ের বুকের দুধ তৈরির প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
· আধুনিক অনেক মাও আবার বুকের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চান না। অথচ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো মায়ের কোলে শিশুর হাসি। অযথা এই চিন্তা আপনার শিশুর হাসি কেড়ে নিতে পারে।
· স্তন ক্যানসারের ভয় রয়েছে অনেক মায়ের। আসল সত্য হলো, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন এবং সারভাইক্যাল (জরায়ুমুখ) ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।
· নবজাতক অনেক সময় ঘন ঘন, অল্প অল্প পায়খানা করে যা স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ কেউ একে ডায়রিয়া বলেন। আবার সত্যি সত্যি বাচ্চার ডায়রিয়া হলেও তারা মায়ের দুধকে দায়ী করেন। অনেক সময় দুধ স্তনে জমে শক্ত হয়ে যায়, প্রচুর ব্যথা হয়। অনেকে দুধে বাতাস লাগা বা হাওয়া লাগা কিংবা হাও লাগা বলেন। ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি করান। মাটির প্রলেপ লাগাতে দেখা যায় অনেক এলাকায়। এ সবকিছুই অন্ধ কুসংস্কার। বুকের দুধ বের করে দিলে বেশিরভাগ সময়ই এই সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যায়।
· যেসব মা হেপাটাইটিস বি পজিটিভ বা ডায়াবেটিসে ভোগেন, তাদের অনেকেই বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন। ধারণা করা হয়, বাচ্চারও জন্ডিস বা ডায়াবেটিস হবে। এটাও একটা বড় ভুল। শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে এই রোগ মা থেকে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং বুকের দুধের সঙ্গে অন্য কিছু খাওয়ালে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। মায়ের জ্বর, কাশি, সর্দি, ডায়রিয়া, এলার্জিসহ সব সাধারণ অসুখেও বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
· ফিডারে কৌটার দুধ খাওয়ালে শিশু ভালো খায়- একথা প্রায়ই শুনতে হয়। কথা সত্য। কারণ কৌটার দুধ খেতে বুকের দুধের চেয়ে সুস্বাদু আর ফিডারের নিপল দিয়ে খাওয়া অনেক সহজ। কিন্তু এর ফলে বাচ্চা আর বুকের দুধ চোষে না, যা মায়ের বুকের দুধ তৈরি কমিয়ে বা বন্ধ করে দেয়।
এ ধরনের প্রচলিত কুসংস্কার আরো অনেক আছে। তবে নবাগত সন্তানের সুস্থতার জন্য এসব ভুল-ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক : শিশু বিশেষজ্ঞ, শিশু বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ