সেনাবাহিনীর নৃশংসা অভিযানের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে দেশটি নতুন অজুহাত খুঁজছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণকালে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শরণার্থীদের জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ কোনোভাবেই দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, ‘আমার দেশে ইতোমধ্যেই ১৬ কোটি মানুষ রয়েছে। আমি আর কোনো বোঝা নিতে পারি না। আমি এটা নিতে পারি না। আমার দেশ এই ভার বহন করতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন। এমন অবস্থায় তিনি শরণার্থী নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে লড়াই করতে চাইছেন না। কিন্তু মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি ও দেশটির ‘মূল ক্ষমতা’ যাদের হাতে সেই সেনাবাহিনীর কথায় আর আস্থা রাখার মতো ধৈর্য ক্রমশ কমে আসছে— এমন ইঙ্গিতও শেখ হাসিনার বক্তব্যে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এর আগেও তিনি কয়েকবার চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
রয়টার্স জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে জানতে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র ঝৌ হাতৌকে ফোন করা হলে এ ব্যাপারে কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, তিনি এখন থেকে ফোনে মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। তবে পাক্ষিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রশ্নের উত্তর দেবেন বলে জানান। গত বছরের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া নৃশংস সেনা অভিযানের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের প্রায় সাত লাখ সংখ্যালঘু মুসলিম পালিয়ে এসে বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেয়। গত নভেম্বরে এ দুই দেশ দুই মাসের মধ্যে শরণার্থী প্রত্যাবাসনের কাজ শুরুর ব্যাপারে এক চুক্তিতে সম্মত হয়। কিন্তু ওই প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে না। এখনো রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে।
মিয়ানমার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা সব কিছুতেই রাজি হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা কোনো কাজ করে না, এটাই সমস্যা। সবকিছু প্রস্তুত কিন্তু... প্রত্যেকবার তারা নতুন কোনো অজুহাত খোঁজে।’
মিয়ানমার বলেছে, তারা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত এবং শরণার্থীদের আবাসনের জন্য ট্রানজিট সেন্টার তৈরি করছে। কিন্তু তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ এ কাজে তাদের কর্মকর্তাদের সহায়তা করছে না। বাংলাদেশ এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘের দাতব্য সংস্থা জানিয়েছে, শরণার্থীদের ফেরার মতো নিরাপদ পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি মিয়ানমারে। বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য ভাসানচর নামে এক দ্বীপে নতুন ঘর তৈরি করছে। অধিকারবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, ওই দ্বীপ বন্যার কবলে পড়তে পারে। কক্সবাজারও বন্যা ঝুঁকিতে রয়েছে কিন্তু চলতি বছরের মৌসুমি ঋতুতে অতটা বন্যা হয়নি।
এদিকে, শেখ হাসিনা রয়টার্সকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য মূল ভূখণ্ডে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব নয় এবং তা গ্রহণযোগ্যও হবে না। তারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের ফিরে যেতেই হবে।’
রোহিঙ্গারা নিজেদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা মনে করলেও দেশটির সরকার তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং রোহিঙ্গা অ্যাকটিভিস্টদের হিসাবে গত এক বছরে সেনা অভিযানে রাখাইনের গ্রামগুলোয় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এ নিয়ে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং অন্যান্য নিপীড়ন চালিয়েছে। যদিও মিয়ানমার সরকার এমন রিপোর্টকে ‘একপেশে’ বলে অভিহিত করে এবং সেনা অভিযানকে আইনসিদ্ধ দাবি করে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দেশের লাগামহীন পরিবহন শিল্পের কারণে ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে দেশটির প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলায় কারাভোগের বিষয়টি জায়গা পায়।