২০১৪ সালের কথা। ৯ বছরের স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী অ্যালিনা মোর্স একদিন বাবার সাথে কোনো এক বিস্ময়কর জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিল। অ্যালিনা মোর্স ও তার বাবার সাথে আরো একজন ছিলেন সেই যাত্রায়। সাথে ছিলেন একজন পথনির্দেশক (গাইড)। তারা হাঁটছিল, এমতাবস্থায় তাদের সামনে এসে ধরা দেন একজন চকোলেট বিক্রেতা। গাইড অ্যালিনার কাছে জানতে চাইলেন, সে চকোলেট বা সাকার/ললিপপ খেতে চায় কি না। গাইড যখন অ্যালিনার কাছে ললিপপ খাওয়ার ইচ্ছের ব্যাপারে জানতে চাইলেন, তখন তা শুনে বাবা অ্যালিনাকে নিষেধ করলেন এবং শান্ত আদরমাখা স্বরে বুঝিয়ে বললেন, ‘মিছরি খাওয়া তোমার জন্য উচিত হবে না কারণ চিনি দাঁতের জন্য অনেক ক্ষতিকর।’ কথাটি সোজা গিয়ে বিচক্ষণ কন্যা অ্যালিনা মোর্সের মগজে টোকা দিয়ে ভাবনায় ফেলে দেয়। বাবা তাকে কেন বারণ করল? বাবা সত্যি বলেছে কি না, এটা তো অনেক সুস্বাদু, শিশুদেরও অনেক প্রিয় তবে বাবা এমনটা কেন বলছে?
ফিরে আসার মুহূর্তে মেয়েটা গাড়িতে বাবাকে প্রশ্ন করল, ‘ড্যাড, তুমি তো বলেছ ললিপপ ক্ষতিকর কিন্তু এত স্বাদের জিনিসটি একটু ভিন্নভাবে তারা বানাতে পারতেন না?’ বাবা সহজ উত্তর দিলেন, ‘মিছরিতে চিনি থাকবেই, চিনি ছাড়া এটা বানানো সম্ভব নয়।’ কিন্তু অ্যালিনা আবার বলল, ‘ড্যাড, একটু ভেবে দেখো না ওটার স্বাদ ঠিক রেখে ক্ষতিকর উপাদান বাদ দিয়ে বানানো সম্ভব কি না। এই বিচক্ষণ প্রশ্নটি এবং আইডিয়াটি বাবাকেও বেশ ভাবিয়ে তোলে। মেয়েটির ইচ্ছে ছিল সে ভিন্ন উপাদান দিয়ে একই রকম একটি সাকার বা ললিপপ বানাবে যা কারো উপকার বৈ ক্ষতি করবে না। আর মা-বাবারাও এই মিছরি বা ক্যান্ডিটি তাদের শিশু সন্তানদের হাতে তুলে দিতে আপত্তি করবে না। ফলে বাচ্চারাও তাদের আবদার করা বস্তুটি পেয়ে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। সে ওই মিছরি খুবই পছন্দ করত এবং কিছুতেই না খাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারত না। যার কারণে এই ভিন্নধর্মী আইডিয়া মাথায় এলো।
এরপর অ্যালিনা যখনই কোনো দোকানে যেত, তখন জিজ্ঞেস করত, চিনিবিহীন ললিপপ বা চুষে খাওয়ার মিছরি আছে কি না? যদি না থাকে তাহলে জানতে চায়, কেউ তার মতো করে এরকম চিনিবিহীন ললিপপ চায় কি না। অ্যালিনার বাবা-মা যখন দেখলেন সন্তান চিনিবিহীন ললিপপের প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে পড়ছে। তখন তারাও এবার গুরুত্ব দিলেন এবং মেয়েকে সাহায্য করা শুরু করলেন। মেয়েকে তারা বিভিন্ন ডেন্টিস্টের কাছে গেলেন, গেলেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শকের কাছে, সাথে ইন্টারনেট তো ছিলই। এভাবেই বাবা, মা ও ছোট্ট অ্যালিনা নিজেদের প্রয়োজনে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেন।
কিছুদিনের মাথায় সে বাবা-মায়ের সহযগিতায় প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেয়। অ্যালিনা মিশিগান ব্লুমফিল্ড পাহাড়ে অবস্থিত স্কচ এলিমেন্টারি পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী। সে পড়াশোনায়ও খুব মনোযোগী থাকার কারণে ললিপপ নিয়ে কাজ করার জন্য স্কুলের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময়কে তিনটি ভাগে ভাগ করে নেয়।
ভাগ ১ : ললিপপ নিয়ে কাজ করার জন্য
ভাগ ২ : পড়াশোনার জন্য
ভাগ ৩ : ছোট বোন লোলার সাথে খেলা করার অন্যসব কিছুর জন্য।
অ্যালিনা পরামর্শকদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভর করে বাবা ও মাকে নিয়ে তার পছন্দের ফল আঙুর ও কমলাসহ বিভিন্ন রকম ফলের ফ্লেভার কীভাবে ললিপপে ব্যবহার করা যায় তা পরীক্ষামূলক চেষ্টায় সফল হয়।
পরীক্ষামূলকভাবে বানানো ললিপপগুলো থেকে প্রথম দিকে যাদেরকে স্বাদ পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে একজন ছিল লোলা, অর্থাৎ অ্যালিনা মোর্সের ছোট বোন। লোলা তখনো ঠিক করে উচ্চারণ শিখে উঠতে না পারায় এই ললিপপকে সে উচ্চারণ করল ‘জলিপপ’। ‘জলিপপ’ শব্দটি অ্যালিনার খুব পছন্দও হলো। নতুন এই বিশেষ ললিপপটির প্রোডাক্ট নাম হিসেবে সে নির্বাচন করে ‘জলিপপ’। কোম্পানির নাম হলো লিকুইড ওটিসি এলএলসি, যার ব্র্যান্ড নাম ‘জলিপপ্স’।
নিজের পরিবারের সদস্যরা যখন এই জলিপপের স্বাদ গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হলো, তখন আশপাশে থাকা লোকজনের কাছে বিতরণ করা শুরু করল। অ্যালিনা মোর্স তার বন্ধু ও নিকটাত্মীয়দের কাছে প্রচার করে। বন্ধু ও নিকটাত্মীয়রা এর খুব প্রশংসা করে যা অ্যালিনা মোর্স ও তার পরিবারের জলিপপ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। সবার প্রশংসা ও শুভকামনা নিয়ে আরো বেশকিছু জলিপপ বানিয়ে আকর্ষণীয় প্যাকেটের মাধ্যমে ভোক্তা আকর্ষণের জন্য কয়েকটি পাইকারি বাজারে এবং খুচরা দোকানে ছেড়ে দেওয়া হয়। নতুন বাজারে আশা বিশেষ রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করে বানানো জলিপপ ভোক্তারাও বেশ ভালোভাবেই লুফে নিয়েছে। এরপর বাবাকে সাথে নিয়ে পণ্যের প্রচারের জন্য বিভিন্ন প্রচারণামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে এবং আরো কিছু খাবারের পাইকারি বাজারে ও বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের কাছে স্যাম্পলসহ বিক্রি করে। বর্তমানে জলিপপ্স আমেরিকার একটি মাল্টি-মিলিয়নিয়ার কোম্পানি।
অ্যালিনা মোর্সের উদ্ভাবিত এবং উৎপাদিত ক্যান্ডিই এখন আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ক্যান্ডি। তার ক্যান্ডিগুলো যেসব নামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তা হলো- জলিক্যান্ডি, জলিপপ্স, জলি ড্রপ্স, জ্যাফি ট্যাফি, জলি ক্যারামেলজ ।
অ্যালিনা মোর্সের এই উদ্ভাবনের গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অনেক খ্যাতি অর্জন করে যা ২০১৫ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সাথেই প্রচার করা হয়। পুরস্কারস্বরূপ এই মেয়েটি যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে সম্মানিত জায়গা হোয়াইট হাউসেও দুবার আমন্ত্রণ পেয়েছিল তৎকালীন ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামা কর্তৃক। আমেরিকায় শিশুদের দাঁতক্ষয় রোগ একটি অন্যতম এনডেমিক, যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে অ্যালিনা মোর্সের প্রতিষ্ঠান।
অ্যালিনা মোর্স একজন আমেরিকান সফল উদ্যোক্তা। তাকে সবথেকে কমবয়সী সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের উলভারিনে ২০০৫ সালের মে মাসে জন্ম নেওয়া মেয়েটি ২০১৪ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে লিকুইড ওটিসি এলএলসি (জলিক্যান্ডি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সে এখন (২০২১) একটি স্কুলের শিক্ষার্থী।
মু. মিজানুর রহমান মিজান