দীর্ঘ বন্ধের পর ক্যাম্পাসে ফিরেছে প্রাণের সঞ্চার। যেন নিথর দেহ ফিরে পেল প্রাণ। শীত এলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি সাজে আপন মনে। সবুজ নগরীর লাল-সাদা শাপলায় পরিপূর্ণ লেকগুলোর শান্ত পানিতে জলকেলিতে মেতে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। মুহূর্তেই কিচিরমিচির শব্দে তাদের একটি ঝাঁক উড়ে ছুটে চলেছে দিগন্তের দিকে। পরক্ষণেই আরেকটি ঝাঁক এসে পানিতে দুরন্তপনা শুরু করছে। এই সুবর্ণ নগরে প্রতিবছরের মতো এবারও আপন মনে বিচরণ অতিথিদের। ঠিক জলরঙে আঁকা ছবির মতো। দিনভর জলকেলি, ওড়াউড়ি ও খুনসুঁটিতে এখন সময় কাটছে তাদের।
শীতের আমেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া বা হিমালয়ের তুষারাবৃত অঞ্চল থেকে শত-সহস্র মাইল পথ পাড়ি দিয়ে অতিথি পাখিরা আসে এই ক্যাম্পাসে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরীতে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে তারা। মূলত নিজ অঞ্চলের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে এসব পাখি। এখানকার জলাশয়গুলোতে মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত তাদের বিচরণ দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রমতে, ১৯৮৬ সাল থেকে এখানকার জলাশয়গুলোতে অতিথি পাখি আসছে। এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি প্রায় ২০৪ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে দেশি প্রজাতি রয়েছে ১২৬টি এবং বিদেশি ৭৮টি। তবে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা কম।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় ১২টি জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয়, মনপুরা এলাকা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের জলাশয়, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের জলাশয় এবং সুইমিংপুল এলাকার জলাশয়ে অতিথি পাখির আধিক্য দেখা যায়। অতিথিদের মধ্যে বেশিরভাগ পাখিই মূলত হাঁস প্রজাতির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সরালি, পান্তামুখী, পাতারি, পচার্ড, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, গার্গেনি, কোম্বডাক, পাতারী হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা, ফ্লাইফেচার ও কামপাখি প্রধান। এছাড়া অন্যান্য অতিথি পাখির মধ্যে রয়েছে লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল, কাস্তে চাড়া, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, মানিকজোড়, খঞ্জনা, চিতাটুপি, বামুনিয়া হাঁস, নাকতা, লাল গুড়গুটি ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও পাখি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, এ বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের দিকে পাখি আসা শুরু করেছে। প্রথম দিকে দুই প্রজাতির পাখি এলেও ক্রমেই তা বাড়ছে। তবে পাখির সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় কম। ডিসেম্বরের দিকে তা পরিপূর্ণ রূপ পাবে।
পরিযায়ী পাখি রক্ষায় এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছর পাখিমেলার আয়োজন করে জাবি’র প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। এ বছর পাখিমেলা হবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক কামরুল বলেন, এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ক্যাম্পাসের চারদিকে এখন অতিথিদের বিচরণ। নিজ আনন্দে তারা গান গেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এক লেক থেকে অন্য লেকে। এমন আচরণে মনে হতেই পারে যেন কোনো উৎসবে মেতেছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সৌরভ শুভ অতিথি পাখি সম্পর্কে তার অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, ‘প্রতি বছর শীতে ক্যাম্পাসে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এসব পাখির কিচিরমিচির ডাকে ক্যাম্পাস আরো বেশি প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। পাখিদের জলকেলি, দিগন্তে দিগ্বিদিক ডানাঝাপটানো ও তাদের খুনসুঁটি আমাদের মনে দোলা দিয়ে যায়। এসব পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে আমাদের সচেতন হতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আবদুর রহমান বলেন, অতিথি পাখি আগমনের অনুকূলে পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখে। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমরা লেকের পাশে সতর্কতামূলক ব্যানার স্থাপন করেছি। এছাড়া পাখির নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতে লেক সংস্কার করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন লেকের পানিতে জন্ম নেয়া অতিরিক্ত কচুরিপানা পরিষ্কার, কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করা হয়েছে।
হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা অতিথি পাখির নিরাপত্তা ও অবাধ বিচরণের জন্য লেকগুলো নোংরা না করা, উচ্চ শব্দে হর্ন না বাজানো, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি বিষয়ে পাখিপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের সচেতন থাকতে হবে।
আসিবুল ইসলাম