মাদকদ্রব্য, বন্দুকযুদ্ধ : প্রসঙ্গ কথা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সম্পাদকীয়

মাদকদ্রব্য, বন্দুকযুদ্ধ : প্রসঙ্গ কথা

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ২৫ নভেম্বর, ২০১৮

‘কুল্লু মুশফিরুন হারামুন’ অর্থাৎ সব নেশাদ্রব্য হারাম। ইসলামের উষালগ্নে নেশাদ্রব্য বা মাদকদ্রব্যকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষের নেশার প্রতি মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হয়েছে, অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টির প্রায় সমবয়সী এই নেশাদ্রব্য। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের পাশাপাশি হেঁটে চলার মতো এই নেশাদ্রব্য। প্রায় সব ধর্মেই নেশাকে বা মাদকদ্রব্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে নেশার বিস্তার মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে, বাংলাদেশ তো বটেই। আর নেশা বা মাদকদ্রব্য রকমভেদে নানা নামের আড়ালে বেচাবিক্রি চলে বিশ্বব্যাপী।

হেরোইন জার্মানরা প্রথম আবিষ্কার করে বেদনানাশকের জন্য। এর অপব্যবহারে এখন এটি মারাত্মক মাদকদ্রব্যে পরিণত হয়েছে। প্যাথেডিনও ব্যথানাশক, অপারেশনের পূর্বে ব্যবহার করা হয়। এই প্যাথেডিনও অপব্যবহারে দুই-একটি অ্যাম্পল ব্যবহার করে কেউ কেউ ঝিম ধরে পড়ে থাকে নেশাগ্রস্ত হয়ে। ফেনসিডিল ছিল ঠান্ডা কাশির ওষুধ। এটিও অধিক ব্যবহারে নেশা বা মাদকদ্রব্যের উৎস হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন তো ইয়াবা বা বাবা টেবলেটের জয়-জয়কার। আরো নানা রকমের মাদকদ্রব্যের ট্রানজিট এখন বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের ফলে মিয়ানমার থেকে কিছুটা বাবা আসা বন্ধ হলেও বড় বড় চালান যেভাবে ধরা পাড়ে, তাতে দেখা যায় রোহিঙ্গা সঙ্কটও এ চালান বন্ধ করতে পারেনি। চালান চলছেই।

ভারত থেকে ফেনসিডিল আসা বন্ধ হয়নি। আসছেই। নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমরা গর্ব করি। এসব মাদকদ্রব্যের রুট বন্ধ না করতে পারলে আগামীতে প্রজন্ম নিয়ে গর্ব করার কিছুই থাকবে না। নেশার করাল গ্রাসে সব উন্নয়নের ছক তছনছ হয়ে যাবে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দিয়ে কিছুই হবে না। এগুলো যাতে দেশের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। রুট বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আক্রান্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

শুধু বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে কাজ হবে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে বেশি সক্রিয় হতে হবে। সেমিনারসহ স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সচেতনতামূলক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ অথবা ব্রিগেড সৃষ্টি করে মাদকদ্রব্য নিরোধে এগিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে এনজিও এবং এ বিষয়ে যেসব সংগঠন কাজ করে তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নিজেরাই এখন দেয়ালে সচেতনতামূলক চিকা মারতে শুরু করেছে। এটা বিভিন্ন সংগঠন দিয়ে করানো যেতে পারে। এনজিও ও সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বছরব্যাপী কর্মসূচি নিয়ে এগোতে হবে। মাঝে মাঝে তাদের অভিযানের খবর পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তৎপরতার চেয়ে র্যাব এবং পুলিশ এ ব্যাপারে অধিক সক্রিয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে অধিদফতরের চেয়ে র্যাব, পুলিশ বাহিনী বেশি আন্তরিক মনে হয়। অধিদফতর বদলি বাণিজ্য, বার নিয়ন্ত্রণ এসব কাজে তৎপর বেশি।

দুর্নীতি দমনের জন্য দুদক স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং সুশীল সমাজের মধ্যে তাদের সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভেতর এ রকম সচেতনতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যদি সম্পদের হিসাব নেওয়া যায়, বোঝা যাবে এই অধিদফতরের অনেকেই দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর যদি প্রকৃত অর্থে সক্রিয় থাকত, তবে এত বন্দুকযুদ্ধের প্রয়োজন হতো না। বিগত দশকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সামাজিক সচেতনতার তেমন ভালো ফল দেখাতে পারেনি। তারা শুধু কোন বার অ্যালকোহল কতটুকু পানি মেশাল তা নিয়ে অধিক ব্যস্ত। আবার তাদেরও খুব দোষ দেওয়া যায় না। এখানে দু’ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। এখানে স্থায়ী কর্মকর্তা আছে কিছু আর অস্থায়ী হিসেবে বড় কর্মকর্তা আসেন কিছু। এই দুই শ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে একটি ঠান্ডা যুদ্ধ সব সময়েই লেগে থাকে। আবার কেউ কেউ ভালো স্থানে বদলি এবং বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন। একসময় ট্রেনিং নিয়ে এক্সপার্ট হয়ে গেলেন, কিন্তু বদলি হয়ে চলে গেলেন অন্য মন্ত্রণালয়ে। তার ট্রেনিং আর কাজে লাগল না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। ইদানীং পত্র-পত্রিকা খুললে দেখা যায়, এ বাণিজ্যের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার লোকজনও জড়িত হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশেই নয় শুধু, বিশ্বের দেশে দেশে এ সমস্যা রয়ে গেছে।

পারমাণবিক অস্ত্রের ট্রিগার যাদের হাতে, তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত। তাদের অসতর্কতায় যেকোনো সময় পৃথিবীতে দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। আমাদের দেশেই যে মাদকাসক্ত তরুণ পেশাজীবী আছে তা নয়, থাইল্যান্ডে শ্রমিক কর্মচারীদের মাসে একবার ডোপ টেস্ট করা হয়- তারা মাদকাসক্ত কি না।

আমাদের দেশে এটা চালু করা যেতে পারে এবং যারা আক্রান্ত তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশে যে পুর্বাসন কেন্দ্রগুলো আছে তাও দক্ষ নয়। এগুলো টাকা কামানোর মেশিনের মতো। তেজগাঁওয়ের সরকারি চিকিৎসা পুনর্বাসন কেন্দ্র তুলনামূলকভাবে বেসরকারিগুলোর চেয়ে অনেক ভালো।

শুরু করেছিলাম হাদিস দিয়ে- কুল্লু মুশফিরুন হারামুন অর্থাৎ সব নেশাদ্রব্য হারাম। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মসজিদ-মাদরাসায় মাদকদ্রব্যের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। পাঠ্যপুস্তকসহ সংবাদপত্র, টিভি এবং চ্যানেলগুলোতে সরকারি উদ্যোগে প্রচার করতে হবে। দেশে মাদকের এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য আমরাই দায়ী, এক দশক দুই দশকের সরকার দায়ী।

সিঙ্গাপুরের মতো জায়গায় প্রকাশ্যে ধূমপান করা তো যাবেই না, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকার কাছে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। ধূমপান হলো মাদকদ্রব্য গ্রহণের ‘গেটওয়ে’। যারা ধূমপান করে তারা অনায়াসে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। যেমন হেরোইন ‘চেজ’-এ তারাই পারঙ্গম যারা ধূমপানে অভ্যস্ত।

আমাদের দেশ ধূমপানে স্বর্গরাজ্য। এদেশে ধূমপান করিয়ে ভোট পাওয়া যায়। তাই যারা ভোটপ্রত্যাশী তারা বুথগুলোয় চা, সিগারেট কয়েক দিনের জন্য ফ্রি করে দেয়। গ্রামগঞ্জে ভোটের সময় ধোঁয়ায় একাকার হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ধূমপান নেশাসক্ত করে। মাদকের এটি প্রথম পর্যায়।

যেকোনো মাদকদ্রব্য চিকিৎসায় বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ছাড়া যায়। কিন্তু ধূমপান সহজে ছাড়া যায় না। সিগারেট দিয়ে আমাদের যে জাতীয় আয় আসে তার হাজারগুণ বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি। মহামারী হিসেবে ফুসফুসের যে ক্যানসার তাতে কয়েক বছরের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে।

এই মর্মান্তিক দিক খেয়াল রেখে এ ব্যাপারে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের সবাইকে নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে। সিগারেটের ওপর অধিক হারে করারোপ করা, নিয়ন্ত্রণ করা। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, কোনো প্রার্থী যাতে বুথে বিনা পয়সায় সিগারেট, চা না দিতে পারে। এগুলোর প্রতি যাতে নির্বাচন কমিশন খেয়াল রাখে। প্রকাশ্য ধূমপানে যে শাস্তির বিধান আছে, এগুলো আমরা ভুলেই গেছি। আইন আছে প্রয়োগ নেই। যার ফলে পুলিশকেও বেপরোয়াভাবে রাস্তায় সিগারেট টানতে দেখা যায়।

ইদানীং পত্রিকায় আসছে নতুন মাদকদ্রব্য আমদানি হচ্ছে, ভুল ডিক্লারেশন দিয়ে। গ্রিন টির নামে উত্তেজক পাতা আমদানি হচ্ছে।

সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন মাদকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদক ব্যবসায়ী নিহত- পত্রিকায় এ শিরোনাম দেখতে চাই না। বনদস্যুদের মতো মাদকের মামলা বা মালামাল নিয়ে আত্মসমর্পণের মতো ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

মাদকের ভয়াবহতা নিয়ত প্রচার করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। সংসদে বসে আইন প্রণয় করলেই চলবে না, নিজ পরিবার থেকে সবাইকে শুরু করতে হবে শুদ্ধি অভিযান। তবেই মাদকমুক্ত হবে দেশ।

লেখক : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads