বাংলাদেশের পোশাক খাত আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পোশাকশিল্প কারখানায় ক্রয়াদেশ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মোট রফতানি আয়ও সমানতালে বাড়ছে, যা সবাইকে দারুণভাবে আশাবাদী করে তুলেছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তৈরি পোশাক রফতানিতে ৮১৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তুলনামূলক ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। যদিও পোশাক রফতানিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ, যা এর আগের ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরের অর্থবছরে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে সেটি বেড়ে ২১ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়। পরের মাসে তা কিছুটা কমে গেলেও সেপ্টেম্বরে আবার বেড়েছে। পোশাক রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হওয়ায় সামগ্রিক পণ্য রফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্বাভাবিকভাবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৯৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আলোচ্য সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩১৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এটি গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৫৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। মোট পণ্য রফতানির ৮২ দশমিক ৩৯ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। আর ওভেন পোশাকের রফতানি ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। ওভেনে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও নিট পোশাকে তা ১২ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পোশাকশিল্প কারখানায় ক্রয়াদেশ বেড়েছে আগের চেয়ে। কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, বিদ্যমান যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সম্পর্কে আস্থা ফিরে এসেছে। কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নানা ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ায় পরিবেশ পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। অতিরিক্ত শুল্কের হাত থেকে রক্ষা পেতে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রয়াদেশ আগের চেয়ে বাড়তে শুরু করেছে। গত কয়েক বছরে আমাদের পোশাকশিল্পে ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়েছে নানা কারণে। আগামী দিনগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ সরকার পোশাকশিল্প শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরির হার নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা পোশাকশিল্প কারখানার মালিকপক্ষকে ভাবিয়ে তুললেও শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ ছাড়া গত্যন্তর নেই। পোশাকশিল্পে ব্যয় বাড়তে থাকলেও বিদেশে সেভাবে উচ্চমূল্যে পোশাক রফতানি করতে না পারায় আয় বাড়ছিল না। ফলে একধরনের হতাশা নেমে আসছিল পোশাকশিল্পে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতে আয়ের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। যে কারণে সংশ্লিষ্ট সবাই বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। বিদেশি ক্রেতারা এতদিন পোশাকের দর বাড়াতে অনেক গড়িমসি করেছেন। তবে ইদানীং বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাড়তে থাকায় তাদের সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প হাঁটি হাঁটি পা পা করে ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাক পণ্যের দারুণ চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। শুরু থেকেই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন শতভাগ কমপ্লায়েন্স কারখানার দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবেশী বেশকিছু দেশ প্রতিযোগিতায় আমাদের তুলনায় এগিয়ে আছে। তাদের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্সের শর্তানুযায়ী এ শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজে প্রচুর বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে ভর করে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে যে আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, তার চমৎকার অনুকূল প্রভাব গোটা অর্থনীতিতে পড়েছে ইতোমধ্যে। সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতি পোশাকশিল্প খাতকে নির্ভর করেই এগোচ্ছে, তা সবাই জানেন। আগামী দিনগুলোতে বিদ্যমান প্রতিকূলতা কাটিয়ে পোশাকশিল্প আরো শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যাবে, প্রত্যাশা সবার। এ লক্ষ্যে সরকারের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা আগের চেয়ে বাড়বে সন্দেহ নেই।
আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারে ক্রেতাদের ধরে রাখতে কয়েকটি কাজ জরুরিভাবে করা দরকার। বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারীরা প্রতিনিয়ত লিডটাইমে মার খাচ্ছেন। সেজন্য গভীর সমুদ্রবন্দর যত দ্রুত সম্ভব নির্মাণ করা দরকার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধান, রেলে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট দূর করতে হবে।
একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের পছন্দের পোশাক সরবরাহকারী দেশের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। তবে বাংলাদেশের ওপর ক্রেতাদের দৃষ্টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এতে করে চীন থেকে সরে আসা ক্রয়াদেশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন আমাদের উদ্যোক্তারা। প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে হলে পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া রফতানির তালিকায় নতুন নতুন পোশাক পণ্য যুক্ত করতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন
লেখক : ব্যাংকার