মাওলানা জালাউদ্দিন রুমি
মাওলানা জালাউদ্দিন রুমি জন্মেছিলেন ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে, বাল্খ শহরে, বর্তমান আফগানিস্তানে। পরে তারা রোম সালতানাদের অধীন আনাতোলিয়ার কোনিয়ায় (বর্তমান তুরস্কে) চলে যান। তখন ক্রুসেডের সময়। খ্রিস্টানরা মুসলমানদের মারছে, মুসলমানরা খ্রিস্টানদের মারছে। অনেক মানুষ তার পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে আছেন একা। তখন একজন মানুষ বসে বসে নিজেকে পোড়াচ্ছেন ইশকের আগুনে। কোথায় চলে গেছেন সেই ক্রসেডের ইতিহাস। কিন্তু, আজো টিকে আছে রুমির মসনবি শরিফ। আজ বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য এক রত্ন। শুধু ইসলামিক বিশ্বে নয়, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত গ্রন্থটি মাওলানা রুমির ইশকের কবিতা। যার মধ্য দিয়ে তিনি পরমকে সন্ধান করেছেন এবং মহান প্রভুর মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন অনেক বড় মাওলানা। কিন্তু একদিন শামসে তাবরেজির সান্নিধ্যে এসে তার জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। তিনি ইশকের সাধনায় নিজেকে সমর্পণ করেন। তাবরেজি সম্পর্কে রুমি লেখেন, আমি ছিলাম জমাটবদ্ধ বরফ, একদিন তাবরেজির সূর্য এলেন, আর আমাকে ফালি ফালি করে কাটলেন। এখন আমি গলে যাচ্ছি, বয়ে যাচ্ছি অনন্ত সমুদ্রের দিকে, আর যখন আমি সমুদ্রে পড়ব তখন আমি আর সমুদ্র এক হয়ে যাব।
সম্ভবত বিশ্বজুড়ে সূফীসাধনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব যিনি ফেলেছেন তিনি মাওলানা রুমি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকায় তার কবিতায় আজো তার কবিতা পঠিত হয় গভীর আবেগ নিয়ে। সাধারণ মানুষ থেকে একেবারে সাধকদের কাছে পর্যন্ত তিনি শ্রদ্ধেয়। ২০০৭ সালে রুমির আটশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক রুমিবর্ষ’ ঘোষণা করেছিল।
শামস-উদ্দিন মোহাম্মদ হাফিজ
মাওলানা রুমির পরই বাংলাদেশে সূফীসাধক বা ইশকের কবি হিসেবে শ্রদ্ধা জানানো হয় তিনি বুলবুল-ই সিরাজ বা হাফিজ। শিরাজ পারস্যের তীর্থভূমি। সেখানে কবি হাফিজ জন্মগ্রহণ করেন চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। ইরানিরা হাফিজকে আদর করে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বা শিরাজের বুলবুলি বলে থাকে। কারণ তিনি শুধু অসামান্য কোরআনই তেলোয়াত করতেন না, অপূর্ব কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন নিজের কবিতা। কোরআনে হাফেজ ছিলেন বলেই তার নাম হাফিজ বা হাফেজ। তার আসল নাম শামস-উদ্দীন মোহাম্মদ। জন্মেছিলেন ১৩২২ সালে, দেহত্যাগ করেছিলেন ১৩৮৯ সালে।
হাফিজের মৃত্যু সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর গল্প প্রচলিত আছে। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য সাহিত্যের সব অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। হাফিজের মৃত্যুর পর একদল লোক তার ‘জানাজা’ পড়তে কবর দিতে অসম্মতি জানায়। হাফেজের ভক্তদলের সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি হলে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় উভয় দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফেজের সমস্ত কবিতা একত্র করে একজন লোক তার যে কোনো স্থান খুলবে। সেই পৃষ্ঠায় প্রথম দুই চরণ কবিতা পড়ে হাফিজের কী ধর্ম ছিল তা ধরে নেওয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয়, এভাবে এই দুই চরণ কবিতা পাওয়া গিয়েছিল-
হাফিজের এই শব হ’তে গো তু’লো না কো চরণ প্রভু
যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।
এরপর উভয় দল মিলে শ্রদ্ধার সঙ্গে হাফিজকে এক দ্রাক্ষাকুঞ্জে সমাহিত করেন। সে স্থান আজ দর্গা বা মাজার। বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ যায় তার মাজার জিয়ারত করতে।
মনসুর আল-হাল্লাজ
রুমি ও হাফিজের পর আরেকজন নিগূঢ়, রহস্যময় সূফীসাধকের নাম বাংলাদেশে খুব পরিচিত। তিনি মনসুর আল-হাল্লাজ। যিনি দাবি করেছিলেন, আনা আল-হক্ক। অর্থাৎ, আমিই সত্য। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ব্যক্তি মানুষ পরম উপস্থিতিরই সাক্ষ্য দেয়। নিজের আধ্যাত্ম সাধনার জন্য তিনি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কোপানলে পড়েন। দীর্ঘদিন বন্দি রাখার পর এক প্রহসনমূলক বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। প্রচলিত আছে, তাকে যখন কেটে টুকরো টুকরো করা হচ্ছিল তখন তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ জিকির করছিল আনা আল-হক্ক, আনা আল-হক্ক। হাল্লাজের এই শহিদত্বকে বিখ্যাত সূফীসাধক ফরিদ উদ্দিন আত্তার বলেছিলেন সূফীবাদের ‘শিখর।’
মনসুর আল হাল্লাজ জন্মেছিলেন ৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে, ৯১৩ সালে তাকে আটক করা হয়, তারপর থেকেই বন্দি। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ৯২২ খ্রিস্টাব্দে। তাকে নিয়ে বহু গল্প-কাহিনী-মিথ প্রচলিত আছে। সূফীবাদের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিটির নাম মনসুর আল-হাল্লাজ। তার পুরো নাম মুঘিত আল-হুসাইন বিন মনসুর। জন্মেছিলেন পারস্যেই। তবে বহুপথ ঘুরে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এসেও তিনি ধর্মীয় আদর্শবাদ প্রচার করেছিলেন। তার প্রভাব এ অঞ্চলের বাউল-ফকির মরমিসাধকদের ওপর পড়েছে ব্যাপকভাবে। মনসুর আল-হাল্লাজের একমাত্র যে গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গভাবে সংরক্ষিত হতে পেরেছে তা কিতাব-আল-তাওয়াসিন। বন্দি থাকার সময় তিনি গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাওয়াসিন, তা ও সিন দুটি আরবি বর্ণ সহযোগে তৈরি, যার নির্দিষ্ট কোনো অর্থ উদ্ধার করা দুরূহ ব্যাপার। কোরান শরিফে সুরা আল-নমল শুরু হয়েছে এ দুটো বর্ণ দিয়ে। কোরআনে এমন আরো কিছু বর্ণ আছে, যার অর্থ কেবল খোদাই জানেন, যেমন- আলিফ লাম-মিম। গ্রন্থটি অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। মনসুর বললেন, আমি তো তোমাকে দেখেছি হূদয়ের চক্ষু দিয়ে। আমি বললাম, কে তুমি? তুমি বললে, ‘তুমি’।