মুক্তমত

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাইসি-বেনেট যুগের সূচনা

  • প্রকাশিত ৫ জুলাই, ২০২১

এম আতহার নূর

 

সুদূর অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত মধ্যপ্রাচ্য। বহু ধর্মের উল্লেখযোগ্য পুণ্যভূমির অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যেই। তাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মেলবন্ধন ঘটে এখানে। এছাড়া ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য অবদান রাখছে ইউরোপ‌-‌এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীসময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা বিস্তৃত হয়। নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় অনারব রাষ্ট্র ইরান, ইসরাইল ও তুরস্ক। উপরন্তু ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের গোড়াপত্তন ঘটে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে ‘ফিলিস্তিন সংকট’ নামে আরেকটি বিপদ নেমে আসে। পঞ্চাশ থেকে নব্ব‌ই দশকে এ ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি হয় এবং সে সময়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন সুন্নি রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের স্বার্থে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সে ঐক্য আর অক্ষুণ্ন নেই। যেমন, বর্তমান সৌদি আরব নিজের নিরাপত্তার বিবেচনায় ইসরাইলি বৈরিতার বিষয়টি বিসর্জন দিতে চাইছে। অন্যদিকে এখনো ইসরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে ইরান। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর যখন সেখানে ধর্মীয় নেতারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন, তখন থেকে প্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সংকট মোকাবিলায় ইরান আবির্ভূত হয় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্গীস্বরূপ। ফলে ইরান যেমন ইসরাইলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তারা বিবেচনা করে ইসরাইল অবৈধভাবে মুসলমানদের ভূমি দখল করে রেখেছে; তেমনি ইসরাইল তাদের অস্তিত্বের জন্য ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে এবং মনে করে।

এ বৈরী সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় সমপ্রতি দুদেশের মধ্যে চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে ‘ছায়াযুদ্ধ’। উভয় রাষ্ট্রের গত সরকারের আমলে পারস্পরিক বিরোধ বেড়েছে। আরো বেশি বিচ্ছিন্ন ও পরস্পরবিরোধী অবস্থানের জানান দিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত উভয় দেশই সত্যিকারের যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যখন এই দুদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈরিতা এবং প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে, ঠিক তখনি দুই দেশের ক্ষমতার মসনদে পালাবদলের ঘটনা ঘটে। দুই দেশেই নির্বাচিত হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নতুন দুজন‌ কট্টরপন্থী নেতা। ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরোধী দলীয় জোট সরকারের কাছে নির্বাচনে হেরে কথিত ‘কিং অব ইসরাইল’ খ্যাত বিনইয়ামিন নেতানিয়াহুর দীর্ঘ ১২ বছর শাসনের পরিসমাপ্তি হচ্ছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক নাফতালি বেনেট ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং জাত্যভিমানের এক প্রতীক হিসেবে তার দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। ৪৯ বছর বয়সি নাফতালি বেনেটকে এক সময় নেতানিয়াহুর শিষ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। তিনি ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি থেকে পদত্যাগ করে বেনেট যোগ দেন ধর্মীয় কট্টরপন্থি দল জিয়ুশ হোম পার্টিতে।

অন্যদিকে ইরানের জাতীয় নির্বাচনে ৬২ শতাংশ ভোট লাভ করে বিজয় পেয়েছেন কট্টর রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত এব্রাহিম রাইসি। যিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনির বেশ ঘনিষ্ঠ এবং ইরানের সবচেয়ে রক্ষণশীল একজন নেতা হিসেবে পরিচিত। ইরানের বিগত জাতীয় নির্বাচনে যখন তিনি সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী হাসান রুহানির কাছে হেরে যান, তখন আয়াতুল্লাহ খামেনি তাকে সম্মানের সঙ্গে ২০১৯ সালে দেশটির বিচার বিভাগের ক্ষমতাশালী পদে অধিষ্ঠিত করছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ইরানের পরমাণু ইস্যু নিয়ে ফের জোট রাজনীতির আভাস দেখা যাচ্ছে। সমপ্রতি ইরান-ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনার তেজ নতুনভাবে বাড়ছে। নানা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সংকট রয়েছে। যার অন্যতম ইরানের পরমাণু কার্যক্রম। দুদেশের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ হতে যাচ্ছে। ইসরাইলে নির্বাচিত নতুন প্রধানমন্ত্রী ডানপন্থি কট্টর নেতা ‘নাফতালি বেনেট’ একজন সাবেক কমান্ডো ও প্রযুক্তি খাতের সফল ব্যবসায়ী। এই অতি কট্টরপন্থি হিসেবে চিহ্নিত বেনেট ইসরাইলকে একটি ইহুদি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতেই বেশি উদ্যোগী। তাই সে সূচনালগ্ন থেকেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। নিজেকে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চাইতেও ‘কট্টর’ হিসেবে দাবি করে থাকেন। জাতীয়তাবাদী নেতা বেনেট বিশ্বাস করেন ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমিসহ যেসব ভূমি দখল করে তা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে ইসরাইলের প্রাপ্য। ইসরাইলের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে বেনেটের দলের অবস্থান যৌথভাবে পঞ্চম, কিন্তু তিনিই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেন ‘কিং মেকার’। কারণ সরকার গড়তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রধান দুটি পক্ষের কাছে পর্যাপ্ত আসন নেই। তাই জোট গঠনে বেনেট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।‌ অতঃপর ইসরাইলের আটটি দল মিলে বেনেট কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। চুক্তি অনুযায়ী ডানপন্থি দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেট শুরুতে প্রধানমন্ত্রী হবেন। এরপর তিনি ইয়াইর লাপিদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। অর্থাৎ আগামী ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত বেনেট ক্ষমতায় থাকবেন।

ইরানের দাবি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্য তারা তাদের পরমাণু কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু ইসরাইল ইরানের এই দাবি একদমই বিশ্বাস করে না। বরং বেনেট প্রথম দিনেই ইরান সম্পর্কে বলেন, ইরানের ‘বর্বর জল্লাদ শাসকরা’ পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে।‌ বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করে বলেন, ‌ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট দেশটির পরমাণু কর্মসূচি জোরদার করবেন। জল্লাদদের রাজত্ব চলছে এমন একটি দেশের হাতে কখনোই গণবিধ্বংসী অস্ত্র তুলে দেওয়া উচিত হবে না। আর এদিকে নির্বাচিত হ‌ওয়ার পরই এব্রাহিম রাইসি ঘোষণা দেন যে, তিনি পুরো জাতির নেতা হবেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে যেকোন কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবেন না। বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্য করে সাফ জানিয়ে দেয়, ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচি নিয়ে আর কোন দরকষাকষি চলবে না। মূলত ইরান ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) স্বাক্ষর করলে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে আমেরিকাকে বের করে ইরানের ওপর আবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এরপরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ পুন শুরু করে। যা উচ্চ মাত্রায় পরিশোধিত ইউরেনিয়াম পারমাণকি জ্বালানির জন্য যেমন ব্যবহূত হয়, তেমনি অস্ত্র তৈরিতেও তা ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে।

ইসরাইল নিশ্চিত যে ইরান গোপনে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে, যা ব্যালেস্টিক ক্ষেপাণস্ত্রের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য হবে। তাই দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে ইসরাইল একপাক্ষিকভাবে গোপনে অঘোষিত তৎপরতা চালাচ্ছে। ইরান ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শীর্ষ পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ মহসিন ফখরিজাদেহ গত বছর তেহরানের কাছে রহস্যজনকভাবে আততায়ীর হাতে নিহত হন। ইসরাইলের বিশ্বাস ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তিনিই পরিচালনা করছিলেন। এছাড়া ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ক্ষেত্রে হামলার জন্যও একাধিকবার ইসরাইলকে দায়ী করে ইরান। যদিও তুলনামূলকভাবে ইরানের বাড়তি কিছু সুবিধা আছে, কিন্তু ইসরাইলের সঙ্গে সমান পাল্লায় লড়াই করার ক্ষমতা যে ইরানের আপাতত নেই তা বিভিন্ন ভাবে আঁচ করা যায়। ইসরাইল আরও দূরপাল্লায় আঘাত হানতে সক্ষম। তাদের গুপ্তচরদের ইরানের ভেতরে দ্রুত কাজ করার দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বে নযির স্থাপন করছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরানকে যতোটা শক্তিধর হিসেবে তুলে ধরা হয় তা অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হয়য়েছে। কেননা পরমাণু স্থাপনা এবং ইরানী বিজ্ঞানীদের উপর ইসরাইলের অব্যাহত আঘাতের কোনো উচিত জবাব দানের সক্ষমতা ইরান দেখাতে পারেনি।

তবে গবেষণার নিরিখে কৌশল ও নতি শিকার কখনো এক জিনিস বলা যাবে না। তাই অক্ষমতা না হয়ে তা খানিকটা সমঝোতার অংশ হিসেবেও ধরা যেতে পারে। যেহেতু তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে এমন একরোখা নীতি গ্রহণ করেছিল, যাতে সবকিছুতে ইসরাইলের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। এতে ইসরাইল যথেষ্ট খুশিও ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বাইডেন সরকারের পলিসি অনেকটা তার বিপরীত দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাইডেন সরকার ইরান পরমাণু ইস্যুতে ২০১৫ সালের বিগত আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তির শর্তে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। তাই বলা যায়, ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বে বাইডেন সমঝোতার আহবান করতে পারেন। যেটা নেতানিয়াহু করেনি। বেনেট সরকার বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিয়ে তাদের পূর্ব অবস্থান পাল্টাতেও পারেন। আসতে পারে দুদেশের নতুন সরকারের হাতে দীর্ঘ বৈরী সম্পর্কের একটা বোঝাপড়ার চিত্র, এক নতুন মোড়। ইসরাইলের ওপেন ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক তামার হারম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন যে, ইসরাইলে এমন অনেক নজির রয়েছে যে কট্টরপন্থী রাজনীতিকরা ক্ষমতায় গিয়ে মধ্যপন্থা নিয়েছেন। যদি ইরানের নবনির্বাচিত এব্রাহিম রাইসি সরকার ইসরাইলের প্রতি তার বৈরী নীতি বাস্তবায়ন বরাবর অব্যাহত রাখে, তবে বেনেট‌ও ইরানের প্রতি বিদ্বেষের আগুন কখনো নমনীয় হবে না, বরং বেনেট সরকার পূর্ব পলিসির ন্যায় আরব দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে ‘ইরানি হুমকি’ টার্ম ব্যবহার করবে এবং ইসরাইল ইরানকে দমন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিতে থাকবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads