গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
প্রয়োজনের তাগিদে দূরদূরান্তে সফর করতে হয়। যদিও এটি একটি কষ্টের অভিজ্ঞতা, তবু এ সময়ও আল্লাহর বিধিবিধান মানতে হবে। এ জন্য ইসলাম সহজতর ইবাদতের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। সফরকালীন নামাজের সংক্ষিপ্ত রূপ ও নির্দেশনা রয়েছে, যাকে বলা হয় সালাতুল কসর বা কসর নামাজ। এটি ভ্রমণকারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূূর্ণ একটি বিষয়। সুরা নিসার ১০১নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কসর নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ মানা ফরজ। কিন্তু এক শ্রেণির মুসল্লি মনে করেন, কোরআনে ভ্রমণকালীন নামাজের কসর বা সংক্ষেপে আদায় করার কথা বলা হয়েছে তো কী হয়েছে? আমরা স্বাভাবিক সময়ের ন্যায় পড়লে তো আর দোষ নেই। আসলে এমন ধারণা ভুল ও গোমরাহি। আরেক শ্রেণির মুসল্লি কসর নামাজের নিয়ম জানে না বলে এটি ত্যাগ করে। শরীয়ত মতে, এটি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তা এক মারাত্মক গুনাহ ও অপরাধ। উল্লেখ্য, এক মঞ্জিল অথবা দুই মঞ্জিলের সফর যদি কেউ করে, তবে তাতে শরীয়তের কোনো হুকুম পরিবর্তন হয় না। শরীয়ত অনুযায়ী তাকে মুসাফিরও বলা হয় না। সব পালনীয় বিধান তার জন্য হুবহু ওই রূপই থাকবে, যেই রূপ বাড়িতে থাকে। যেমন চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ চার রাকাতই পড়তে হবে।
যে ব্যক্তি কমপক্ষে তিন মঞ্জিল স্থানে যাওয়ার নিয়ত করে বাড়ি হতে বের হবে এবং অনূর্ধ্ব ১৫ দিন থাকার নিয়ত করবে তাকে শরীয়ত অনুযায়ী মুসাফির বলা হবে। যখন সে নিজ শহরের লোকালয় অতিক্রম করবে, তখন তার ওপর মুসাফিরের হুকুম বর্তাবে। এখন প্রশ্ন হলো, তিন মঞ্জিল কী? চলতি পথে খাওয়া- দাওয়া, পাকসাফ, আরাম-বিশ্রামের সময় বাদ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে, নৌকায় বসে কিংবা উটের পিঠে চড়ে তিন দিনে যতদূর পৌঁছা যায় তাকে তিন মঞ্জিল বলে। আরব দেশে প্রায় মঞ্জিল নির্ধারিত থাকে। আমাদের দেশে মোটামুটি হিসাবে এর দূরত্ব ৪৮ মাইল। এই নির্দিষ্ট দূরত্ব কোনো দ্রুতযানের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের ব্যবধানে অতিক্রম করলেও মুসাফিরের বিধান প্রযোজ্য হবে। যে ব্যক্তি শরীয়ত অনুযায়ী মুসাফির, সে জোহর, আসর ও এশা ফরজ নামাজ দুই রাকাত পড়বে এবং সুন্নত নামাজের হুকুম এই যে, যদি ব্যস্ততা থাকে তবে ফজরের সুন্নত ব্যতীত অন্যান্য সুন্নত ছেড়ে দেওয়া দুরস্ত আছে। এতে কোনো গুনাহ হবে না। আর যদি ব্যস্ততা না থাকে, তবে সুন্নতগুলো ছাড়বে না। সফর অবস্থায় সুন্নত পড়লে তা পুরোপুরিই পড়তে হবে। সুন্নতের কসর হয় না। আর ফজর, মাগরিব এবং বিতরের নামাজের কসর নেই। একই ভাবে জোহর, আছর এবং এশা- এই তিন ওয়াক্ত নামাজ সফরের হালতে ইচ্ছা করে চার রাকাত পড়লে গুনাহ হবে। যদি কেউ বাড়ি হতে তিন মঞ্জিল অপেক্ষা বেশি দূরে যাওয়ার নিয়ত করে বের হয়, কিন্তু পথে ঘটনাক্রমে কোনো স্থানে ২-৪ দিন থাকার দরকার হয়ে পড়ে তার পর প্রায় প্রতিদিনই খেয়াল করে যে, কাল/পরশু চলে যাব, কিন্তু যাওয়া হয় না। এরূপ করে যদি বহুকালও ওই স্থানে থাকা হয় এবং কোনো সময়েই অনুর্ধ্ব ১৫ দিন থাকার ধারণা না হয়, তবে সে যত দিন ওই স্থানে থাকবে ততদিন মুসাফিরই থাকবে, মুকিম হবে না। তাকে মুসাফিরের নিয়ম মানতে হবে। স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে সফর করে ও স্বামীর সঙ্গ ছাড়া অন্যত্র যাওয়ার খেয়াল না থাকে, তবে এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর নিয়তের কোনো মূল্য নেই। স্বামী যেরূপ নিয়ত করবে, স্ত্রীরও সেই রূপ নামাজ পড়তে হবে। যদি কারো মুসাফিরের হালতে নামাজ কাজা হয় ও সেই নামাজ মুকিম হালতে কাজা পড়তে চায়, অর্থাৎ বাড়িতে ফিরে আদায় করতে চায়; তবে জোহর, আছর এবং এশার দুই রাকাত করেই কাজা পড়বে। এরূপ মুকিম হালতে যদি নামাজ কাজা হয়ে থাকে এবং সে নামাজ মুসাফিরি হালতে আদায় করতে চায়, তবে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ চার রাকাতই পড়তে হবে। দুই রাকাত পড়বে না। মুকিম বা স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য মুসাফির ইমামের পেছনে ইকতেদা করা জায়েজ আছে। তবে মুসাফির ইমাম (চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজ) যখন দুই রাকাত পড়ে সালাম ফেরাবে অর্থাৎ উভয় দিকে সালাম ফিরিয়ে সারবে তখন মুক্কিম মুক্তাদিরা আল্লাহু আকবার বলে দাঁড়াবে এবং অবশিষ্ট দুই রাকাত নিজে নিজে পড়ে নেবে। অবশ্য সালামের সঙ্গে সঙ্গে ইমামের বলে দেওয়া উচিত তিনি মুসাফির। সব মুক্তাদি যেন বাকি নামাজ নিজে নিজে আদায় করে নেন। তবে জামাতের আগেই কথাটি বলে রাখা উত্তম। একইভাবে কোনো স্থানীয় ইমামের পেছনে মুসাফির ইকতেদা করতে পারেন, তবে এ ক্ষেত্রে তাকে ইমামের অনুসরণে পূর্ণ নামাজ আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে আরো কিছু মাসয়ালা-মাসায়েল রয়েছে। এসব হুকুম আহকাম জানার মাধ্যমে আমরা আমাদের নামাজ কালাম আল্লাহর দরবারে আরো গ্রহণীয় করে তুলতে পারি।
লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক