ভেটেরিনারিয়ানরা সময়ের সাহসী সন্তান

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

ভেটেরিনারিয়ানরা সময়ের সাহসী সন্তান

  • প্রকাশিত ২৫ এপ্রিল, ২০২১

মাত্রই গত হলো বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। ভেটেরিনারিয়ান বা ভেট মূলত তাদেরই বলা হয় যারা সব ধরনের প্রাণিসম্পদ ও পোলট্রির চিকিৎসা করে থাকেন। প্রাণী চিকিৎসকরাই সাধারণত ভেটেরিনারিয়ান নামে পরিচিত। একটি দেশের পুষ্টি, বিশেষ করে প্রোটিন, আমিষের চাহিদার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন এই ভেটেরিনারিয়ানরা।

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস, সারা বিশ্বের প্রাণী সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ একটি দিন। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিনামূল্যে প্রাণীর চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, টিকাদান কর্মসূচির মতো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করে থাকে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘ভেটেরিনায়ান রেসপন্স টু দ্য কোভিড-১৯ ক্রাইসিস’। প্রতিপাদ্যের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়, ভেটেরিনারিয়ানরা কেবল প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখছেন তা নয়, তারা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অশ্রান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ভেটেরিনারি ক্লিনিকগুলো তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম—ফেস শিল্ড, পিপিই, ভেন্টিলেটরের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী, পিসিআর মেশিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) ল্যাবে ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ল্যাবে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের কাজ চলছে।

মহামারীতে বিশ্বে ভেটেরিনারিয়ানদের বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে। ফাইজারের কোভিড ভ্যাক্সিন আবিষ্কার টিমের প্রধান ড. আলবার্ট বোরলা একজন ভেটেরিনারিয়ান। আমাদের দেশের ভেটেরিনারিয়ান বিজন কুমার শীল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন করে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, সারা বিশ্বে যত ভাইরাসঘটিত জেনেটিক রোগ আছে তার শতকরা ৭০ ভাগের উৎপত্তি বন্যপ্রাণী থেকে। বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ে। সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, ইবোলা, মার্স, সার্স, র্যাবিস, মারবুর্গ, লেপটোসিরোসিস এবং বর্তমান কোভিড-১৯ এসব মহামারীর উৎস প্রাণী। মানব কল্যাণে ভেটেরিনারিয়ানরা এসব রোগের ওপর গবেষণা করছে।

পৃথিবীর প্রাণিকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না। মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিকুলের সুস্থতা প্রয়োজন সবার আগে। এজন্য প্রাণী স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিওভিএ) যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ (ওআইই), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) এবং ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও)-এর সঙ্গে সারা বিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৫৯ সালে স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। আর ২০০১ সালে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন ভেটেরিনারি পেশার সাথে কর্মরত সকল ভেটেরিনারিয়ানের জন্য একটি বিশেষ দিন আয়োজনের প্রস্তাব করে, যেটা নির্ধারিত হয় প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার। দিবসটির মূল লক্ষ্য ভেটেরিনারি পেশাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। প্রাণী, পরিবেশ ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাণী পরিবহন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখা। বিশ্বের সব সদস্য দেশের বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস উদ্যাপনের ওপর ভিত্তি করে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে থাকে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথম দি ভেট এক্সিকিউটিভ আয়োজন করে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসটি। বর্তমানে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (বিভিএ), দি ভেট এক্সিকিউটিভ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি যৌথভাবে দিনটি নানা আয়োজনে উদ্যাপন করে থাকে।

প্রাচীনকাল থেকেই ভেটেরিনারি শিক্ষা সারা বিশ্বের মানব কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। খ্রিস্ট্বপূর্ব ২৫০০ সন থেকে চীন দেশের অধিবাসীরা প্রাণীর চিকিৎসাসমূহ প্যাপাইরাস নামক গাছের পাতায় লিখে রাখতেন। ভেটেরিনারি শিক্ষার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ক্লয়ডি বারজিলেট নামক এক ব্যক্তি ফ্রান্সের লিয়ন শহরে ১৭৬১ সালে পৃথিবীর সর্বপ্রথম ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম ভেটেরিনারি স্কুল রয়েল কলেজ অফ ভেটেরিনারি সার্জন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় আমেরিকাতে ১৮৭৯ সালে প্রথম ভেটেরিনারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক ভেটেরিনারি পেশার যাত্রা শুরু হয় ১৭৭৪ সালে ‘ঘোড়া প্রজনন খামার’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরে দক্ষ ভেটেরিনারিয়ান তৈরির উদ্দেশে ১৮৭৭ সালে ভারতের বাবুগড়ে প্রথম ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষার গোড়াপত্তন কুমিল্লাতে, ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট কুমিল্লাতে প্রথম ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়। পরে ১৯৫০ সালে কলেজটি ঢাকার তেজগাঁও স্থানান্তরিত হয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৫ বছর মেয়াদি পশুপালন ডিগ্রি চালু করা হয়। ১৯৬২ সালে ময়মনসিংহে সবর্প্রথম ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে নামকরণ করা হয়। এখানে ১৯৬৩ সালে পশুপালন এবং প্রাণী চিকিৎসা ডিগ্রি পৃথককরণ করা হয়। ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে থেমে নেই প্রাণিসম্পদ নিয়ে গবেষণা। প্রাণী চিকিৎসকরা বিভিন্ন গবেষণা, বিভিন্ন প্রাণীর নতুন জাত উদ্ভাবন ও জাত উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি, যেমন দুগ্ধ উৎপাদন, ডিম উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদের সর্বোপরি পরিচর্যার জন্য ভেটেরিনারি ডাক্তারের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষি খাত ব্যাপকভাবে প্রাণিসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন ছাড়া কৃষিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। আর প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ ভেটেরিনারিয়ানদের। আধুনিক উপায়ে পশুপালন, প্রজনন, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে একজন ভেটেরিনারিয়ানকে জ্ঞান অর্জন করতে হয়।

দেশের মোট প্রাণিজ আমিষের ৭৬ শতাংশ আসে ডিম, দুধ ও মাংস থেকে। করোনাকালে উৎপাদন ঠিক  রাখতে ভেটেরিনারিয়ানরা সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে দেশে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৪৫ হাজার। প্রাণিসম্পদ এই উন্নয়নের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন ভেটেরিনারিয়ানরা। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে দুধ, ডিম, মাংস জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন। এ ছাড়া করোনাকালে টেলিমেডিসিন সেবা, ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিক নিয়ে ভেটেরিনারিয়ানরা জনমানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।

প্রাণির স্বাস্থ্য সেবা, খাদ্য, চিকিৎসা, লালনপালনে একমাত্র দায়িত্ব বর্তায় ভেটেরিনারিয়ানদের ওপর। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, বেকারত্ব নিরসন এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে ভেটেরিনারিয়ানদের অবদান অনেক।

 

আর এস মাহমুদ হাসান

লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads