দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিনগুলোকে স্মরণ, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে স্মরণ করিয়ে দিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় ভাস্কর্য। যেগুলো চিরজাগ্রত হয়ে যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আপামর জনতার স্বাধীনচেতা, অকুতোভয় মানসিকতার সাহসী প্রতিবিম্ব হয়ে ভাস্কর্যগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। তেমনই কয়েকটি ভাস্কর্য নিয়ে লিখেছেন ক্যাম্পাস প্রতিনিধিরা।
সংশপ্তক
সংশপ্তক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে একটি বিখ্যাত ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি স্বাধীনতার স্মৃতি আর গৌরবের মহিমায় মহিমান্বিত। ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ নির্মিত হয়েছিল স্মারক ভাস্কর্য সংশপ্তক। মূল ভূমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাওয়া দেশমাতৃকার বীর সন্তান। নিজ মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা যাদের স্বপ্ন, শত্রুর বুলেটের সামনেও জীবন তাদের কাছে তুচ্ছ। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি।
আসিবুল ইসলাম, জাবি
স্মরণ
মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী বীর সন্তানদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর এই স্মৃতিস্তম্ভটির স্থপতি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। ভূমি থেকে স্মরণের মূল বেদি পর্যন্ত চারটি ধাপ রয়েছে, যার প্রতিটি ধাপ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রথম ধাপ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, দ্বিতীয় ধাপ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, তৃতীয় ধাপ সত্তরের নির্বাচন ও চতুর্থ ধাপে প্রতিফলিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্মৃতিস্তম্ভটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে। তারা হলেন-প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীর প্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, চাকসুর জিএস আব্দুর রব, শিক্ষার্থী ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, ফরহাদ-উদ-দৌলা, নাজিম উদ্দিন খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাষ কুমার বড়ুয়া এবং প্রহরী সৈয়দ আহমদ।
কামরুল হাসান, চবি
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষ দিকে এসে জাতিকে মেধাশূন্য করার নতুন পরিকল্পনায় মেতে ওঠে পাকবাহিনী। দেশকে মেধাশূন্য করতে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে রাজাকার-আলবদররা। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় এ স্মৃতিস্তম্ভ। কেরন গাছের পরিবেষ্টনে চত্বরটি বর্তমানে বিভিন্ন উৎসবের মিলনকেন্দ্র। শিল্পী রশিদ চৌধুরীর নকশায় এটি প্রণয়ন করা হয়। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮৫ সালে।
কামরুল হাসান, চবি
বিজয় ৭১
ছয় ফুট উঁচু বেদির ওপর এক কৃষক মুুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছেন আকাশ পানে। ডান পাশেই শাশ্বত বাংলার সংগ্রামী নারী কাঁধে রাইফেল নিয়ে দৃঢ়চিত্তে দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ডাক। অন্যদিকে তেজোদীপ্ত এক ছাত্র বাঁ হাতে রাইফেল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিমায়। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘বিজয় ৭১’। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিসংগ্রামে বাংলার সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক হয়ে আছে ভাস্কর্যটি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের সব ষড়যন্ত্র, ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে অনেকে শহীদও হয়েছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে সেসব ত্যাগের স্মৃতি ধরে রাখতেই বাকৃবি ক্যাম্পাসে এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। ভাস্কর্য শিল্পী শ্যামল চৌধুরী এটির নকশার পরিকল্পনা করে দিলে, সবারই পছন্দ হয়। পরে ১৯৯৮ সালে তার তত্ত্বাবধানে ভাস্কর্যটির নির্মাণ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০০ সালের জুনে। ভাস্কর্যটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৪ লাখ টাকা।
বাবুল হোসাইন, বাকৃবি
মুক্তবাংলা
‘মুক্তবাংলা’ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের অন্যতম স্মারক ভাস্কর্যটি আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের আঙ্গিকে ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রশাসন ভবনের পূর্ব পাশে স্থাপন করা হয়। খ্যাতিমান স্থপতি রশিদ আহমেদের নকশার ভিত্তিতে এটিকে অপরূপ এক সৌন্দর্যে রূপ দেওয়া হয়। ‘মুক্তবাংলা’র সাতটি স্তম্ভ সম্বলিত গম্বুজের ওপর রয়েছে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার রাইফেল, যা সাত সদস্যের মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রতীক। প্রতিটি স্তম্ভ বিস্তৃত প্রসারিত হাত উল্লসিত অবয়বে স্থাপত্য ভিত্তিক আর্চ রচিত, চোখে লাল সূর্য উদয়ের প্রত্যাশা। সর্বনিম্নে বিস্তৃত সিরামিক বড় ইট লাগাতার আন্দোলনের নির্দেশক। এ ছাড়া ওপর থেকে চতুর্থ ধাপে লাল সিরামিক ইট আন্দোলন ও যুদ্ধের প্রতীক, দ্বিতীয় ধাপে কালো পাথর শোক ও দুঃখের প্রতীক, তৃতীয় ধাপে সাদা মোজাইক সন্ধি ও যোগাযোগের প্রতীক এবং বেদির মূল মেঝে সবুজ মোজাইক নীল টাইলস শান্তির প্রতীক। সম্পূর্ণ অবকাঠামোটি সাতটি আর্চ সংবলিত একটি অর্ধ উদিত (উদীয়মান) সূর্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকতে ডানদিকে সবার নজর কাড়ে ব্যতিক্রমী মুক্তিযুদ্ধের এই স্থাপত্যটি।
সোহানুর রহমান, ইবি
শাবাশ বাংলাদেশ
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাস্কর্যের নাম ‘সাবাস বাংলাদেশ’। যেটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়(রাবি) চত্বরে অবস্থিত। চিত্রশিল্পী নিতুন কুণ্ডের অনন্য শৈল্পিক হাতের জাদুকরী ছোঁয়ায় দেশের অন্যতম নান্দনিক এই ভাস্কর্যটি গড়ে উঠেছে। ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নিতুন কুণ্ড ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ ভাস্কর্যটি নির্মাণ কার্য শুরু করেন। উদ্বোধন করেন শহীদ জননীখ্যাত জাহানারা ইমাম। ভাস্কর্যে রাইফেল হাতে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখা যায়। একজনের পরনে প্যান্ট, অন্যজন লুঙ্গি। যেটা মুক্তিযুদ্ধে সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের চিত্রটি ফুটে তুলেছে। ভাস্কর্যে আরো দেখা যায়, একজনের মধ্যে প্রচণ্ড গতিময়তা এবং অন্যজন স্থির। যেটা যুদ্ধের মাঠে অস্ত্রের লড়াইয়ের পাশাপাশি স্থির বুদ্ধির লড়াইয়ের চিত্রটি ফুটে তুলেছে। যুদ্ধ জয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও গতিময়তা এবং স্থির যুদ্ধ কৌশলের চিত্র এই দুজন যোদ্ধার মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে ফুটে তোলা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পদতলে দুপাশে বাঙালির জীবনযাত্রার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বাম পাশে দেখা যায় কয়েকজন বাউল মিলে গান করছেন। যেটা বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক এবং হাজার বছরের গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির চিত্রকে ফুটে তুলেছে। ডান পাশে দেখা যায়, মায়ের কোলে সন্তান এবং পতাকা হাতে কিছু নারী দাঁড়িয়ে আছেন, যেটা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়কে নির্দেশ করে। এটি নির্দেশ করে বাঙালি মায়ের ভাষা ও ইজ্জতের বিজয়কে। মুক্তিযুদ্ধাদের পেছনে প্রাচীরের মাঝে বৃত্ত বাংলাদেশের পতাকাকে নির্দেশ করে। যেখানে বীর বাঙালি মাতৃভূমি রক্ষায় সম্মুখপানে থেকে দৃঢ়চিত্তে হানাদার মোকাবিলার চিত্রকে ফুটে তুলেছে। নিতুন কুণ্ডের নিপুণ হাতের জাদুকরী ছোঁয়ায় কালজয়ী এই লাল বেলে মাটির ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী ইতিহাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলার চূড়ান্ত এক বিজয়ের জীবন্ত চিত্র।
রায়হান ইসলাম, রাবি