কবি-সাহিত্যিক-লেখক কি প্রচল কোনো মতাদর্শের অনুসারী? নাকি লেখক নিজের সৃষ্ট মত বা আদর্শ চাপিয়ে দিতে চান পাঠক মহলে? ইয়েটস ও টিএস এলিয়ট প্রবর্তিত আধুনিকতা বাংলা কাব্যসাহিত্যে অনুপ্রবেশ লগ্ন থেকে বাম-ডানের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। কবি-সাহিত্যিকরাও স্ব-সৃষ্ট কিংবা আরোপিত মতাদর্শ নিয়ে বিভাজিত হয়ে পড়েন। এ বিভাজন নতুন নয়, বরং সৃষ্টিপর্ব থেকে কালান্তরে ধাবমান। মতাদর্শ সাহিত্যে এক ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করে। তিরিশ কালপর্বে কবিরা প্রচল কাব্যধারার পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করেছিলেন ফলে তাদের কবিতায় শ্রমজীবী ও জনতাভিত্তিক সমাজচেতনার উন্মেষ দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে একসময় উপেক্ষিত ও বিতর্কিত মার্কসবাদ তিরিশের কবিদের মননে তীব্র আবেগ জুগিয়েছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ পর্বের কবিরা নিজেদের অ্যান্টি রোমান্টিক আখ্যা দিয়ে ‘রবীন্দ্রদর্শন’ ত্যাগ করে নৈরাশ্যবাদী ভাবধারায় কবিতা চর্চার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ফ্যাসিস্টবিরোধী ভূমিকায় দায়বদ্ধতার প্রশ্নে বিষ্ণু দে’ও এ পথে শামিল হন। এ ধারায় ক্রমেই তার শৈল্পিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রবিযুক্তির প্রত্যয়ে বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে যে ভাবাদর্শে কাব্যসৌধ নির্মাণ করেছেন, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য পশ্চিমা জ্ঞান ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এবং পূর্বসূরি জারিত। তার কবিতার বিমুগ্ধ পাঠে ধরা পড়ে মার্কসীয় মতাদর্শ। সমকালীন যুগযন্ত্রণা, আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের সমন্বয় এবং স্বদেশ চিন্তাও তার কবিতার একটি বিশেষ লক্ষণ। বেঁচে থাকার তাগিদে এ পর্বের কবিরা মানুষের মৌল আকাঙ্ক্ষার দাবিতে প্রতিবাদী চেতনা তুলে আনতে সচেষ্ট থেকেছিলেন তাদের কবিতায়, যা বিশ্বসাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত। তবে মার্কসীয় দর্শনতাড়িত হলেও বিষ্ণু দে’র নিজস্ব কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি কবিতায়। তিনি সচেতনভাবেই কবিতায় দর্শন ও বিজ্ঞানের মিশেল ঘটিয়েছেন। তার কবিতায় যেমন আছে নিসর্গ চেতনা, তেমনি আছে ভক্তিবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবল উপস্থিতি। আছে মিথ-পুরাণের সফল প্রয়োগ। তৎকালীন ভারতবর্ষে সমাজবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে সাংস্কৃতিক ধীমানরা বিদেশি সাহিত্যে নিজেদের মুক্তি খুঁজেছিলেন। এ ধারায় অগ্রবর্তী কবি বিষ্ণু দে’র তার অধিকাংশ কবিতায় মার্কসীয় আদর্শের তাত্ত্বিক ঘোষণা স্পষ্ট করেন। তিনি মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক চেতনা ভিন্ন মানবিক চেতনার বিজয় অসম্ভব। সুতরাং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তার কবিতায় ‘মৃত্যুহীন মানুষের জয়গাথা’ রচিত হয় অনায়াসে— ‘অমর দেশের মাটিতে মানুষ অজেয় প্রাণ,/মুঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।/হে বন্ধু জেনো, আজ যবে খোলে মুক্তিদ্বার,/দেশে আর দশে ভেদাভেদ শুধু ভীরুতা ছার!’ (মৃত্যুহীন মানুষের জয়গাথা)
বিষ্ণু দে’র স্বদেশ প্রেম একদিকে ঐতিহ্যবাহী, অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী, যা একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে আদর্শিক ভিত্তিতে জনগণতন্ত্রবাদী। তিনি ইতিহাস চেতনার পথে বিশ্বযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কূটকৌশল, ঔপনিবেশিক শাসন ও বৈশ্যতান্ত্রিক দোদুল্যমান ভারতীয় মধ্যবিত্তের ভূমিকাবিষয়ক বোধ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে স্থিত হয়েছেন। ফলে তিনি কবিতায় তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন, ফ্যাসিস্ট শক্তির নিষ্ঠুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী মানুষের প্রবল প্রতিবাদ। শ্রেণিশোষণ ও ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় আশা করেছেন। ‘৭ নভেম্বর’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন :
সেই তিক্ত বঞ্চনার, বাণিজ্যলক্ষ্মীর রক্তাতুর
সাম্রাজ্যের অভিসার ধূলিসাৎ প্রাণের বিপ্লবে।
স্বাধিকারে মুক্তি আজ, ন্যায়যুক্তি-প্রতিষ্ঠ জীবন।
নাগরিক বৈদগ্ধের বিপরীতে তিনি এঁকেছেন সুস্থ জীবনের ছবি। তার প্রগতিচেতনার মূলে বিকশিত হয়েছে সাধারণ মানুষের জয়গান ও সমাজচেতনার নিবিড় ধারাপাত, যা ‘সন্দীপের চর’ কবিতায় ‘প্রাণস্রোতস্বিনী নদী’র প্রতীকে উপস্থাপিত। তিনি ‘কবিতার খাল কেটে’ দেশবিদেশের জলস্রোতের মিশ্রণে মানবমৈত্রীর বোধ রচনা করেন। ‘সাম্যের সঙ্গীত সত্য’ করতে গিয়ে কট্টর মার্কসবাদীদের সঙ্গে আদর্শিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেও তিনি শ্রেণিচেতনার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।
তার কবিতায় স্তবক পরম্পরায় আপাত-সম্পর্কহীন বিন্যাস ও বিমূর্ততা আধুনিক কবিতার এক অনিবার্য শিল্পফসল হিসেবে চিহ্নিত। তার প্রথম পর্যায়ের ‘সন্দীপের চর’ এবং ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ গ্রন্থের কবিতায় ফরাসি প্রতীকবাদ আশ্রিত প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যা টিএস এলিয়টের কবিতার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে ফরাসি প্রতীকবাদের সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন আর্থার সায়মন্স। ‘দ্য সিম্বলিস্ট মুভমেন্ট ইন লিটারেচার’ গ্রন্থে সায়মন্স মালার্মে প্রচলিত শব্দের ‘কাম্য বিকল্প’ এবং মূল অর্থ থেকে দূরে সরে যাওয়া শব্দরাশির ‘উপর্যুপরি বিন্যাস’-এর কথা বলেন। কবিতার প্রতিপাদ্য ও অর্থ খুঁজতে থাকা পাঠকের ‘হতবুদ্ধি’ হয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি এ দুটি প্রবণতার উল্লেখ করেন। বিষ্ণু দে’র উর্বশী ও আর্টেমিস-এ পরম্পরাহীন স্তবক বিন্যাস যে মালার্মে এবং এলিয়টের পিক্তবিন্যাস প্রভাবিত এ কথা বলা অসঙ্গত হয় না। তবে মার্কসীয় দর্শন গ্রহণের পরে তিনি ধীরে ধীরে স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাব্যসৌধ নির্মাণ করেন। কবি বিষ্ণু দে’র কাব্যাদর্শ থেকে বামপন্থি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা গভীর প্রেরণা ও সমর্থন লাভ করেছেন বলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
বিদেশি সাহিত্যের বিপুল পাঠে বিষ্ণু দে’র মানসলোক পরিশীলিত। ফলে এলিয়ট ও এজরা পাউন্ডের কাব্যচিত্রকল্প ও বাক্যবিন্যাসের সংহতিও তার কাব্যজগতে ব্যাপক প্রভাবসঞ্চারী। কবিতায় তার দর্শন এবং শব্দ ব্যবহারে এক ধরনের ঋজুতা ও দৃঢ়তা দীক্ষিত পাঠককে টানে। বিষ্ণু দে’র কাব্যভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার নিজস্ব যুক্তিবাদী দর্শন ও সামাজিক কল্যাণবোধ। একজন কবিও যে চিন্তার সুস্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও যুক্তিবাদী দর্শনের মাধ্যমে কবিতায় অতলস্পর্শী সাফল্য অর্জন করতে পারেন, বিষ্ণু দে তার উজ্জ্বল উদাহরণ। যে কারণে তার কবিতার ব্যবহূত শব্দসমবায়ে এক ধরনের সৌম রুচির সন্ধান মেলে। কট্টর মার্কসবাদী সংস্কৃতি অঙ্গনের কেউ কেউ এলিয়টকে অবক্ষয় ও প্রতিক্রিয়াশীল কবি হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিষ্ণু দে’র অভিমত ছিল এর বিপরীতে। তিনি এলিয়টকে আধুনিক সাহিত্যের ‘মহৎ কবি’ মনে করতেন। মনে করতেন বাস্তব জীবনের রূপকার এবং বস্তুবাদী চৈতন্যের ধারক। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপক ও প্রচ্ছন্ন সহমর্মিতা এবং এ প্রভাবের সদর্থক দিকের পাশাপাশি বিষ্ণু দে’র কবিতায় জটিলতার দিকটিও লক্ষণীয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিষ্ণু দে’র মননেও গভীর রেখাপাত করে। সামাজিক দায়বদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ কবি ব্যক্তিবাদী সীমাবদ্ধতার দেয়াল ভেঙে সমষ্টিচেতনায় উঠে আসেন। সাধারণ মানুষের কাতারে যেতে উত্তরণ ঘটে কবিচিন্তার। কবিতায় সগর্বে উঠে আসে গণজাগরণের কাব্যকথা। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের মানবিক আবেদন এবং বলিষ্ঠ ভাষ্যে প্রকাশ পায় শ্রেণিসংগ্রামের নির্দেশনা। তার শ্রেণিচেতন মানসিকতার সফল রূপায়ণ ‘মৌভোগ’ কবিতায় তিনি ভাগচাষিদের যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন যা পরবর্তী সময়ে ‘তেভাগা আন্দোলন’-এ প্রেরণা জোগায়। কবিতায় লালকমল-নীলকমলের মাধ্যমে তিনি অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সংগ্রামী চেতনা তুলে ধরেন— ‘জন্মে তাদের কৃষাণ শুনি কাস্তে বানায় ইস্পাতে/কৃষাণের বউ পঁইছে বাজু বানায়।/যাত্রা তাদের কঠিন পঠে রাখীবাঁধা কিশোর হাতে/রাক্ষসেরা বৃথাইরে নখ শানায়।.../এদিকে ওড়ে লালকমলের নীলকমলের হাতে/ভায়ের মিলে প্রাণের লালনিশান।/তাদের কথা হাওয়ায়, কৃষাণ কাস্তে বানায় ইস্পাতে/কামারশালে মজুর ধরে গান।’
একথা বলা অসঙ্গত হয় না যে, বিষ্ণু দে দীক্ষিত কবি যেমন স্বাদেশিকতায় তেমনি আন্তর্জাতিকতায়; বিষয়ের ব্যাপকতায়, নানা ভাষ্যে এবং একাধিক প্রতীকে। তার কবিতায় মানবিক প্রাণের স্পন্দন প্রভাবসঞ্চারী, পাশাপাশি দেশজাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষ মানুষের জয়গানে একাত্ম। মার্কসীয় দর্শনে প্রভাবিত হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’। যে কারণে ঈশভাবনাও তার কবিতার মর্মমূলে সঘন। জীবনকে সত্য করে তুলতে তার যাত্রা ‘অবিশ্রাম ভাঙনের সাগর সঙ্গমে’। তবে ভাষাগত সারল্য সঙ্কটে তার কাব্যপ্রাসাদ সাধারণ পাঠকে ব্যাপক সমাদৃত নয়। কিন্তু মনোযোগী ও নির্বিচারী পাঠক কবি চৈতন্যের মেলবন্ধনে ‘আমার ভাবনা বাঁচে জীবন মৃত্যুতে দুইতটে বলীয়ান’ হয়ে সংগ্রামী আহ্বানে ‘পড়ে থাক এ আত্মঘাতীর অনাদ্যন্ত খেয়োখেয়ি.../চলো যাই জীবনের তরঙ্গমুখর সমুদ্র সৈকতে’ পৌঁছে যান অনায়াসে।