আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এতে দেশের ব্যবসায়ীরাও যেন প্রতিযোগিতা করে পণ্যটি আমদানি করছেন। কারণ দেশের বাজারে সেই তুলনায় দাম না কমায় পণ্যটিতে মুনাফা বেড়েছে আগের থেকে কয়েকগুণ বেশি। চিনির উৎপাদন ততটা না থাকায় বাংলাদেশের বাজারে এর দাম কত হবে, তা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের দর এবং চাহিদার তুলনায় মজুতের ওপর। এ করণে সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বাড়লে দেশের বাজারেও কয়েক দিনের মধ্যে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু এক দশকের মধ্যে পণ্যটির দাম সর্বনিম্নে এলেও দেশে সেই তুলনায় দাম কমেনি। বলতে গেলে দাম না কমিয়ে স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল বঞ্চিত হচ্ছেন ভোক্তারা।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম নিয়ে কাজ করে ইনডেক্স মুন্ডি। সংস্থাটির তথ্যে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতিকেজি চিনির দাম নেমেছে দশমিক ২৪ ডলার বা ২৪ সেন্টে। এর আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক দফা চিনির দাম এতটা কমেছিল। তবে সেটা ২৫ সেন্টের নিচে নামেনি। আর ঠিক এক দশক আগে বিশ্ববাজারে চিনির দাম ছিল ২৬ সেন্ট।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যে, শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোয় চিনি উৎপাদন প্রচুর বেড়েছে। এতে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে বিশ্ববাজারে চিনি ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ মৌসুমে ভারতে রেকর্ড ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চিনি উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারত সরকার রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে এ দাম ভবিষ্যতে আরো কমবে বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের বাজারে এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে গড়ে সাড়ে ৫২ টাকা কেজিতে। বিগত ৮ বছরে কখনো চিনির দাম ৫০ টাকার নিচে নামেনি। যদিও এক দশক আগে (২০০৮ সাল) দেশে চিনির গড় দাম ছিল ৩৯ টাকা, যা ২০১০ সালে ৫৬ টাকা ৫০ পয়সায় পৌঁছায়। আর দেশে সবচেয়ে বেশি ৬৮ টাকা চিনির দাম উঠেছিল ২০১৬ সালে।
এমতাবস্থায় দেশের চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, বিশ্ববাজারের মতো এত বেশি না হলেও দেশের বাজারেও পণ্যটির দাম কমেছে। কিন্তু সরকার নির্ধারিত ডিউটি ও ট্যারিফের পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে দেশে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিনির দাম সমন্বয় করা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ব্রাজিলে এখন চিনি ৩১৫ ডলার প্রতিটন। কিন্তু সে চিনি আমদানি করে আমাদের ৩৫০ ডলার দর হিসেবে ট্যারিফ ও ডিউটি পরিশোধ করতে হয়। সেটা সরকারের নির্ধারিত সর্বনিম্ন রেট। ওই ৩৫০ ডলার হিসেবেই আমরা প্রায় ৪৭ শতাংশ ডিউটি দিচ্ছি। এর মধ্যে স্পেসিফিক ডিউটি ২ টাকা ৫০ পয়সা হারে, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ১০ শতাংশ। এ কারণে চিনির দাম বিশ্ববাজারে কমলেও এর সুফল বাজারে মিলছে না।
দেশে চিনি আমদানির ক্ষেত্রে তীর ব্র্যান্ডের বাজারজাতকারী সিটি গ্রুপ এবং ফ্রেশ ব্র্যান্ডের বাজারজাতকারী মেঘনা গ্রুপ এগিয়ে। এ দুটি কোম্পানিই বাজারে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চিনি সরবরাহ করে থাকে। তাদের প্রত্যেকের বাজার অংশীদারিত্ব বা মার্কেট শেয়ার প্রায় কাছাকাছি। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপ, আবদুল মোনেম গ্রুপের (ইগলু) ও দেশবন্ধু গ্রুপের (দেশবন্ধু) চিনি বাজারে বেশি প্রচলিত।
বাংলাদেশ পুষ্টি কাউন্সিলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৪ লাখ টন। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চাহিদা ১৬ লাখ টনের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চালু ১৫টি চিনিকলের চিনি উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন। যদিও সক্ষমতার থেকে এখন উৎপাদন অনেক কম। ফলে দেশে সরকারি চিনিকলগুলোর পর্যাপ্ত উৎপাদন না থাকায় এ চাহিদা বেসরকারি খাতে আমদানি করা চিনি (রিফাইনারি সুগার) দিয়ে পূরণ হচ্ছে।