মো. সাইফুল ইসলাম খোকন, চকরিয়া (কক্সবাজার)
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সেন্টমার্টিন থেকে বাঁকখালী নদীর মোহনা, কুতুবদিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সামুদ্রিক উপকূলে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ঝিনুকের আবাসস্থল রয়েছে। এসব অঞ্চলের ঝিনুকে মুক্তা পাওয়া যায়। তবে লোনা পানির ঘেরে বাণিজ্যিকভাবে ঝিনুক চাষ করা যায় কিনা তা নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো গবেষণা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা শুরু করেছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।
সমুদ্রের লোনা পানির ঝিনুক চাষের সম্ভাবনা নিয়ে দেশে ইতিপূর্বে কোনো গবেষণা হয়নি। তবে সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা আহরণের সম্ভাবনা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল। এক যুগ আগের সেই জরিপে দেখা গেছে, বাঁকখালী নদী মোহনা, মহেশখালী, সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গায় প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা উৎপাদনকারী পাঁচ প্রকারের ঝিনুকের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে করতাল নামক এক প্রকার ঝিনুকে মুক্তার সন্ধানও তারা পান। পানির ১-২ মিটার গভীরতায় বালুকাময় তলদেশে ও ১৮-২২ পিপিটি লবণাক্ততায় একটি ঝিনুক বা করতালে গড়ে ৫টি হতে সর্বোচ্চ ১২টি মুক্তা পাওয়া গেছে। তবে পরিবেশদূষণ, আবাসস্থল পরিবর্তন, নির্বিচারে ঝিনুক আহরণ ইত্যাদি কারণে বর্তমানে প্রাকৃতিক উৎস থেকে ঝিনুক ও মুক্তার প্রাপ্যতা অনেকাংশে কমে গেছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী বলেন, এদেশের উপকূলীয় এলাকায় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকের আবাসস্থল কক্সবাজার, মহেশখালী, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়া, উখিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপসহ প্রায় সমগ্র সমুদ্র-উপকূল। যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় জনসাধারণ এসব এলাকা থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে। জোয়ারের সময় শামুক-ঝিনুকগুলো উপকূলে ভেসে আসে। এ সময় স্থানীয় লোকজন সেখান থেকে মুক্তা সংগ্রহ করে।
তিনি জানান, দেশে ১৯৯৯ সালে স্বাদুপানিতে পরীক্ষামূলকভাবে মুক্তাচাষ শুরু হলেও লোনাপানিতে মুক্তাচাষের গবেষণা কার্যক্রম এটাই প্রথম। এদেশে স্বাদুপানির ঝিনুকের ৬টি প্রজাতি এবং সামুদ্রিক লোনাপানির ঝিনুকের ১৪২টি প্রজাতি রয়েছে। উপকুলীয় এলাকার এসব ঝিনুক বিভিন্ন কাজে ব্যবহূত হলেও মুক্তা তৈরিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার বলে তিনি জানান।
তিনি আরো জানান, বিশ্বের প্রায় স্বল্প উষ্ণপ্রধান ও উষ্ণপ্রধান সামুদ্রিক জলাশয় ঝিনুকের আবাসস্থল। এরা সমুদ্রের স্বল্প গভীর হতে ৮০ মিটার গভীর এলাকায় বিচরণ করে। প্রায় ৩০টি সামুদ্রিক ঝিনুক প্রজাতির মধ্যে ৩টি সামুদ্রিক প্রজাতির ঝিনুক বাণিজ্যিক মুক্তা উৎপাদনে ভূমিকা পালন করে।
ঝিনুকের খোলস চুন, অলঙ্কার, গৃহ সাজসজ্জাকরণ উপকরণ তৈরি ও পোল্ট্রি ফিশ ফিড মিলে ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং ঝিনুকের মাংসল অংশ চিংড়ি, মাছ ও হাঁস-মুরগির খাবার হিসেবেও ব্যবহূত হয়। বিশ্বের অনেক দেশে ঝিনুকের মাংসল অংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে সাধারনত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ঝিনুকের মাংস খেয়ে থাকে।
ড. জুলফিকার আলী জানান, বিশ্বের অনেক দেশে সামুদ্রিক ঝিনুক (ওয়েস্টার) একটি দামি সিফুড হিসেবে ব্যবহূত হয় এবং এর ওপর ভিত্তি করে নানা খামারও গড়ে উঠেছে।
তিনি জানান, ১৯৯০ এর দশকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক ঝিনুক উৎপাদন শুরু হয়। অথচ আমরা এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছি।
বাণিজ্যিকভাবে ঝিনুক চাষের আরো গুরুত্ব তুলে ধরে বিজ্ঞানী জুলফিকার আলী বলেন, মানুষ ও জলজ পরিবেশে উভয়ের জন্য ঝিনুক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয় থেকে শৈবাল, জৈব পদার্থ এবং দ্রবীভূত ক্ষতিকারক উপাদান যেমন- ভারী ধাতু দূরীকরণে ঝিনুকের ভূমিকা রয়েছে। তাই ঝিনুক প্রাকৃতিক পানি পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। জলজ খাদ্যশৃঙ্খলের ক্ষেত্রেও ঝিনুক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এরা জলজ খাদ্য শিকলের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। ঘেরে ঝিনুক চাষের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন সম্ভব।