পবিত্র হজ পালনের সুপ্ত ইচ্ছা বুকে নিয়ে জায়েদা বেগম (ছদ্মনাম) চড়েছিলেন সৌদি আরবের বিমানে। ভেবেছিলেন গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে যে পারিশ্রমিক পাবেন, তা দিয়েই এই পুণ্য দেশে হজ পালন করবেন। কিন্তু তার সে ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাত্র তিন মাসের মাথায় তাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আকুতি জানান পরিবারকে। এরপর এ বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সহায়তায় নির্যাতিত জায়েদাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এটি শুধু একজন জায়েদা বেগমের নয়, সৌদি অভিবাসী শত শত নারী শ্রমিকদের চিত্র, যেখানে তারা প্রতিনিয়ত মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতিত হচ্ছে।
জীবনে একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় প্রতিনিয়ত মানুষের ছুটে চলা। সচ্ছল জীবন আর সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান অনেকেই। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে। সংসারের হাল ধরতে এই নারী গৃহকর্মীরা কিংবা ক্লিনারের মতো কাজ নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। পেছনে কেউ রেখে যাচ্ছেন তার সন্তান, কেউবা বৃদ্ধ বাবা-মা। কিন্তু অভিবাসী এসব নারী শ্রমিক যে স্বপ্ন বা আশা নিয়ে যাচ্ছেন, তার কতটুকুই বা পূরণ হচ্ছে?
সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার হয়ে অভিবাসী নারীদের দেশে ফিরে আসার সংখ্যা বেড়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওর বরাতে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে শুধু চলতি বছরের মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত রিয়াদের ইমিগ্রেশন ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরেছেন ৩৫০ নারী শ্রমিক। এনজিও ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশে ফেরত আসা নারী শ্রমিকের সংখ্যা গত তিন বছরে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ লাখ নারী বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশে গেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ অভিবাসন বিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে। ২০১৫ সালে সৌদি সরকারের সঙ্গে সে দেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ নারী সৌদি আরব গেছেন। বিএমইটির দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর ১৮টি দেশে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে গেছেন ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন। অভিবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও তাদের অনেকেই সে সব জায়গায় নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অল্প কয়েকদিনের মাথায় দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসার ফলে একেবারে নিঃস্ব হাতে দেশে ফিরছেন তারা।
কেস স্টাডি
১. কাজের কথা বলে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সৌদি আরবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর থেকেই তার ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়। মেয়েটি তাতে রাজি না হওয়ায় বেধড়ক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হলে মেয়েটির পা ভেঙে যায়। মেয়ের এমন দুরবস্থার কথা বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন মালার (ছদ্মনাম) মা। মালাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও মেয়ে সুস্থ হলে আবারো এমন নির্যাতনের শিকার হতে হবে বলে আতঙ্কিত তার মা। মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করছেন।
২. শারমিন এক এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর তাকে কয়েকবার বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। প্রতিটি জায়গায় সে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। শুধু যৌন নির্যাতনই নয়, লোহার রড গরম করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গায়ে বিভিন্ন জায়গায় জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছে। দুই হাত শিকলে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেও চলেছে নির্যাতন। সারা শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় সে দেশে ফেরে।
৩. হালিমা (ছদ্মনাম) খুব বেশিদিন হয়নি একটু সচ্ছলতার আশায় গিয়েছিলেন সৌদি আরব। কিন্তু দিন দিন গৃহকর্তার নির্যাতন বেড়েই চলছিল। একদিন বাসার সবাই তাকে রেখে বাইরে দাওয়াত খেতে গেলে সে নিজের শাড়ি, দড়ি, অন্যান্য টুকরো কাপড় বেঁধে সেটি বেয়ে দোতলা পর্যন্ত নেমে আসেন। একপর্যায়ে সেখান থেকেই নিচে লাফিয়ে পড়েন। এতে কোমরে মারাত্মক আঘাত পান। সে আঘাত নিয়েই কোনো রকমে আশ্রয় কেন্দ্রে যান। সেখান থেকে তাকে দেশে পাঠানো হয়।
হালিমা, শারমিন, মালার মতো অসংখ্য নারী এমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিদেশে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দা সাহানা বারী জানান, সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি আমলে এনে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
যেসব কারণে ফিরে আসছেন নারীরা
এ পর্যন্ত দেশে ফেরত আসা প্রায় প্রত্যেক নারীই তাদের ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের কথাই বলেছেন বার বার। অনেকেই দগদগে সেসব চিহ্ন নিয়ে ফিরেছেন। ৩১ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সৌদি ফেরত কয়েকজন নারী তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দেন। শারমিন, মৌসুমী, কুলসুম এবং লতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উঠে আসে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। সকাল ৬টা থেকে রাত ১টা দেড়টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে বাধ্য করত মালিকরা। কিন্তু সে অনুযায়ী ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। যে বেতন দেওয়ার কথা বলে কাজে নেওয়া হতো, তাও সময়মতো দেওয়া হতো না। মালিকের কাছে টাকা চাইলেই মারধর করা হতো। কখনো গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে, ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে, খুন্তি গরম করে শরীর পুড়িয়ে দিয়েও চলেছে নির্যাতন।
সৌদি ফেরত কুলসুম বলেন, বাড়ির কর্তা ও পরিবারের লোকজন নির্যাতন করত। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতো না। অনেক মেয়েকে পরিবারের ছোট-বড় সবাই যৌন নির্যাতন করেছে। নির্যাতনে অসুস্থ হলে এজেন্সির ক্যাম্পে পাঠায় তারা। সেখান থেকে কেউ বাড়িতে ফিরতে চাইলে তাকে আবার নির্যাতন করা হয়। এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে এসব বিষয় জানানো হলে তারাও তেমন গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন যারা
বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেশন (বিএসএসএম), ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ওয়ারবি ফাউন্ডেশন, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট ফর রিসার্চ ইউনিট, বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা), অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকুপ), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, আওয়াজ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরাম (বোয়াফ), বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাসহ আরো প্রায় ১১টি বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহযোগিতা পেতে পারেন ভুক্তভোগী পরিবার।
আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনীহা
সৌদি আরবে নির্যাতিত অভিবাসী নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। ২০১৭ সালে উইনরক ইন্টারন্যাশনাল ইউএসএইডের অর্থায়নে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ’ প্রকল্পের আওতায় সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীদের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৭ জন নারীকে। সংস্থাটির প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মোজাম্মেল হক কিছুটা আক্ষেপ করেই বলেন, ‘আমরা একজন ভিকটিমকে আইনি সহায়তা এবং ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা গেছে, দেশে ফিরে সেই অভিযোগকারী পরিবারগুলোই কোনো অদৃশ্য কারণে আর মামলা করতে চায় না বা মামলা হলেও এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়। এতে করে সে পরিবারটি নিজেও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় এবং রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও জবাবদিহিতার দায় এড়িয়ে যেতে পারে।’
কয়েকটি সুপারিশ
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান অভিবাসী নারী শ্রমিকদের পক্ষে কয়েকটি দাবি তুলে ধরে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সৌদি আরবসহ বিদেশে কাজ করতে যাওয়া প্রত্যেক নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত, ফেরত আসা গৃহকর্মীর ক্ষতিপূরণ, দোষী গৃহকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দূতাবাসের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ, গৃহকর্তা বা গন্তব্য দেশের এজেন্সি কর্তৃক গর্ভবতী নারী শ্রমিক ও তার শিশুর সম্পূর্ণ দায়িত্ব বহনসহ যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। নির্যাতনের শিকার এসব নারীকে নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ আশা করছেন।