রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের আধা ডজন নিয়ন্ত্রক সংস্থার। এর মধ্যে দু-একটি সংস্থা মাঠে কাজ করছে। তবে নানা সীমাবদ্ধতায় এসব সংস্থা বাজার দর নিয়ন্ত্রণ নয়, বাজারে ঘোরাঘুরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আর কোনো কোনো সংস্থা এখনো সময় করে উঠতে পারেনি বাজারে যাওয়ার। ফলে ভোক্তারা এখনো এসব পদক্ষেপের কোনোই সুফল পায়নি। উল্টো দিন দিন বেড়ে চলা নিত্যপণ্যের দামে তারা নাকাল হয়ে পড়েছে।
সরকারের গোয়ান্দা সংস্থা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিম, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, র্যাব-পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ রমজানকেন্দ্রিক পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনও মাঠে থাকার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল রমজান শুরুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাজারে সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার তদারকি নজরে পড়েনি।
তাও আবার সিটি করপোরেশন বাজারে যাওয়ার পর কমদামে পণ্য বিক্রি শুরু করে ব্যবসায়ীরা। ফলে মেয়রের অনুধাবন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা বাড়লেও তা ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে। গতকাল ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন হাতিরপুল বাজারে রমজান উপলক্ষে পরিদর্শনে গিয়ে গেল বছরের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকাংশেই কম বলেও দাবি করেছেন।
এদিকে সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোন বাজারে পণ্যের দাম কত হবে তাও তালিকা রয়েছে সব বাজারের প্রবেশমুখে। কিন্তু সে দাম মানে কে? যদিও গতকাল কোনো বিক্রেতা এই দামের বেশি চাইলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুশিয়ারি দেন সাঈদ খোকন।
ক্রেতারা বলছে, রোজার বাজার এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে সব ধরনের পণ্যের দাম। এরপরও সরকার বলছে, বাজার নজরদারি শুরু হবে। সেটা কবে? কেনাকাটার পর এসব নজরদারির দরকার কী? প্রতিবছর এই ধরনের লোক দেখানো নজরদারির কারণেই ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা, খিলগাঁও, হাতিরপুল ও মালিবাগসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে নতুন করে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে সবজির দাম। দু-তিন দিনের তুলনায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে ৬০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজিই। বেগুনের দাম আরো বেড়ে মানভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা ও পেঁপে ৬০ টাকায় উঠেছে।
এ ছাড়া বাজারে আরো দাম বেড়েছে সব ধরনের মুরগি, মাংস, ছোলা, আদা ও রসুনের। যদিও ব্যবসায়ীরা অজুহাত হিসেবে বলছে, চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ফলে পাইকারি পর্যায়ে দাম বেশি। রয়েছে সরবরাহ সঙ্কটও।
যদিও বাজার ঘুরে কোথাও কোনো সবজি বা পণ্যের সঙ্কট লক্ষ করা যাচ্ছে না। আর ক্রেতারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা রমজানে অধিক মুনাফার লোভে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। মূলত রমজানকে টার্গেট করেই প্রতিবছরই তারা দাম বাড়ায়।
একই অভিযোগ ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমানের। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দেশে কোনো পণ্যের সঙ্কট নেই। সে বিষয়ে ভোক্তা ও সরকারও নিশ্চিত। আসলে রমজানের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যবসায়ীরা। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিচ্ছে।
প্রতিবছরই রমজানের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেওয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ কয়েকবার বৈঠক করলেও পণ্যের দাম বাড়ানো ঠেকানো যায়নি। আধা ডজন বাজার মনিটরিং সংস্থা নিযুক্ত করা হলেও ভোক্তারা কোনো সুফল পায়নি।
লোকবল নেই ভোক্তা অধিকারের
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠে রয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। রমজানে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতোমধ্যেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ অধিদফতর কাজ শুরু করেছে। এ মাসের শুরু থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করার কিছু কার্যক্রম নিলেও শেষ পর্যন্ত বাজারদর নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই অধিদফতরটির।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটি হচ্ছে আমরা পাইকারি বাজারে বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোয় অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু খুচরা দোকানে গিয়ে মনিটরিং করা বেশ কঠিন। এর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জনবল আমাদের নেই। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বিএসটিআইয়ের নজরদারিতে গতি নেই
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনেরও (বিএসটিআই) নিয়মিত বাজার তদারকি করার কথা। তবে বাজারে খুচরা পণ্যের দাম কমা-বাড়া নিয়ন্ত্রণ এ সংস্থার দেখার বিষয় নয়। তাই সেভাবে এখনো মাঠে নামেনি সংস্থাটি। আগের মতোই দু-একটি মোবাইল কোর্টের সঙ্গে রমজানে কিছুটা বাড়তি তদারকির ব্যবস্থা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) তাহের জামিল বলেন, আমরা বাজার পর্যবেক্ষণে এলে মান, দাম ও মেয়াদের বিষয়ে তদারকি করি। আর এ কার্যক্রম নিয়মিত হয়ে থাকে। আর রমজানে এবার সেই কার্যক্রমের সঙ্গে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বিএসটিআই এককভাবে এসব মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে না। এসব যৌথভাবে করতে হয়। ফলে প্রশাসনের সহায়তা পেতে সমস্যার কারণে সব সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা সম্ভব হয় না।
মাঠে নামার সিদ্ধান্ত হয়নি বিএফএসএ’র
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) বিশেষ কিছু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার কথা থাকলেও গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত এসব কার্যক্রম কবে থেকে শুরু হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন দৈনিক পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে প্রচার, জেলা ও উপজেলায় বাজার, দোকানপাট, পাড়া-মহল্লায় মাইকিং করতে ব্যস্ত সংস্থাটি।
মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমের দেখা নেই
দোকানে মূল্যতালিকা রয়েছে কি না সেটা পর্যবেক্ষণ করার কথা রয়েছে এ মনিটরিং টিমের। কিন্তু রাজধানীতে কোনো তালিকায় বাজারদর ঠিকঠাক নেই। এসব তালিকার এমন অবস্থা যে কবে শেষ তা হালনাগাদ হয়েছে বোঝা দায়। আর মনিটরিং টিমের কে কোথায় কীভাবে কাজ করছে তাও জানে না বাজারের কেউ। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোজার বাজার মনিটর করতে মন্ত্রণালয় ১৪টি মনিটরিং টিম গঠন করেছে। ইতোমধ্যে এই কমিটি বাজারে অভিযান শুরু করেছে।
গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে নীরবেই
এ রমজানে দেশের চারটি সংস্থার গোয়েন্দারা নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি মনিটর করছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। রমজানে কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ালে এসব সংস্থার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গেছে ইতোমধ্যে কিছু সংস্থা অবৈধ মজুতের সন্ধান পেলে মজুতকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে তা জানা যায়নি।