ছবি : সংগৃহীত

আবহমান

বাংলা সনের সূচনা ও বিতর্ক

  • ফিচার ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১৫ এপ্রিল, ২০১৮

আগামীকালই ১৪২৫ বঙ্গাব্দে পা দেবে বাংলা বর্ষপঞ্জির ক্যালেন্ডার। নানা আয়োজন আর উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন এই বছরকে বরণ করে নেবে বাঙালি। যদিও সাধারণভাবে আমরা দৈনন্দিন কার্যকলাপে বাংলা সন ও তারিখ নয়, বরং ইংরেজি ক্যালেন্ডারকেই অনুসরণ করি। বাংলা তারিখের কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে অনেকেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান। কিন্তু তার পরও প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো হিসাবটিই আমাদের প্রাণের ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারের গুরুত্বকে বাঙালির খাটো করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ কি ভেবেছেন, কীভাবেই বা এল এই ক্যালেন্ডার?

বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস নিয়ে দুটি মত রয়েছে। কারো কারো মতে, বাংলা সনের হিসাব যত, বর্ষপঞ্জিটির বয়সও তত। আর বাংলা এই সন গণনা শুরু করেছিলেন রাজা শশাঙ্ক। তাদের মতে, ইংরেজি সালের ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকের কিছু সময় বাংলা তথা গৌড়ের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তিনি প্রথমে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা অর্থাৎ বর্তমানের ভারত-বাংলাদেশের বাংলা এলাকার সামন্ত শাসক ছিলেন। ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে, শেষ গুপ্ত সম্রাট শক্তিহীন হয়ে পড়লে শশাঙ্ক গুপ্ত অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে বাংলা তথা গৌড় রাজ্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ঘটনা ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের এবং সেই বছর থেকেই বাংলা সন চালু হয়। এ ব্যাপারে সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গাব্দের উৎস কথা’ শীর্ষক একটি পুস্তিকায় বলেছেন, ‘সৌর বিজ্ঞানভিত্তিক গাণিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।’

বহু ভাষাবিদ রহমতুল্লাহ বাঙালি তার ‘বঙ্গাব্দের জন্মকথা’ গ্রন্থেও ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দের সূচনা এবং রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত প্রকাশ করেছেন।

এই যুক্তিটিকে আক্ষরিক অর্থে অকাট্য মনে হলেও আসলে দ্বিতীয় মতটিকেই যথার্থ মনে করেন গবেষকরা। দ্বিতীয় মতানুসারে বাংলা সনের প্রবক্তা আসলে মোগল সম্রাট আকবর। এই যুক্তিটির সঙ্গেই মিশে আছে বাংলা সন কেন বাঙালির প্রাণের অংশ- এই ধারণাটিও। দ্বিতীয় মত অনুসারে, ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সব কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরি পঞ্জিকার দিন-ক্ষণের হিসাব চাঁদের ওপর নির্ভর করত। চান্দ্রমাসের হিসাবে প্রতিবছর সৌর বছরের চেয়ে ১১-১২ দিন কম হয়। সে অনুযায়ী সৌর বছর ৩৬৫ দিন আর চন্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চন্দ্র বছরের ঋতুগুলো ঠিক থাকে না। কিন্তু চাষাবাদের জন্য কৃষকরা আবার ঋতুনির্ভর। এজন্য মোগল সম্রাট আকবর তখনকার প্রচলিত হিজরি সন থেকেই বাংলা সনের হিসাব শুরু করেন। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই মতটিকে সমর্থন করেন। এ দলের সমর্থকদের মতে, সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন হিজরি সন ছিল ৯৬৩ এবং বাংলা সনও ছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ। যেহেতু ঋতুকে ঠিক রাখার জন্য সৌর বছরকে অনুসরণ করে বঙ্গাব্দ হিসাব করা হয়, তাই প্রায় শত বছরের ব্যবধানে প্রতিবছর ১১ দিন করে কম হওয়ায় হিজরি সন এখন ১৪৩৯।

এ ছাড়া আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে লেখা আছে, ‘আকবর বহুদিন ধরে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনগণনা সমস্যা সহজ করে দেওয়ার জন্য এক নতুন বছর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরি অব্দ ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। আমির ফয়জুল্লাহ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এ অব্দের প্রবর্তন হলো।’

সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফয়জুল্লাহ শিরাজীকে হিজরি চন্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমির ফয়জুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ইংরেজি ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবর হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর আগে তার সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরি সন থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সনের মহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। আর যেহেতু বাংলা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুপ্রাচীন কাল থেকেই কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাই এ ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটি স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads