বাংলা চলচ্চিত্রের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৫৬ সালে প্রথম সবাক বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির পর থেকে শুধুই এগিয়ে চলা। এরপর নির্মিত হয়েছে কালজয়ী সব চলচ্চিত্র। বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, স্বনামধন্য অভিনেতা ও পরিচালকের মন্তব্যসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে আজকের আয়োজনটি সাজিয়েছেন কামরুল আহসান, সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন, ইশতিয়াক আবীর ও মনিরা তাবাসসুম
চলচ্চিত্র সমাজের আয়না- বহু পুরনো কথা, যেদিন থেকে চলচ্চিত্রের সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকেই এ কথা সত্য। নতুন সত্য হচ্ছে এ আয়না আজকালের ধুলোয় মলিন, ঝাপসা। চলচ্চিত্রের বয়স একশ বছরের কিছুটা বেশি। সেদিক থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বয়সও নেয়াত কম নয়। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় প্রথম বাংলাদেশি সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। বাংলা চলচ্চিত্র অবশ্য এর মধ্যেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বিকাশ। তার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন। স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাপও পড়েছে এ দেশের চলচ্চিত্রের প্রাথমিক লগ্নে। উর্দু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ষাট-সত্তর দশকের ছবিতে এ দেশের সংস্কৃতির আত্মপ্রকাশ হতে শুরু করে। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, খান আতাউর রহমানের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, সালাউদ্দিনের ধারাপাতের মাধ্যমে চিরায়ত বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতা বজায় থেকে একাত্তর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে। স্বাধীনতার পরই এ দেশের চলচ্চিত্র নিজের পায়ে দাঁড়ায়। সূচনা ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের এক সোনালি দিনের। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি নির্ভর আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে থাকে এ দেশের একেকটি চলচ্চিত্রে। স্বাধীনতার পরপরই আবির্ভূত হন এদশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ, প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে গল্পে ও নির্মাণে আধুনিকতা নিয়ে আসেন। তারই সঙ্গে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও আসে নতুন একটি যুগ। এ সময়ই মুক্তি পায় আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’, আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’, জহিরুল হকের ‘রংবাজ’, খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’।
এসব ছবি গানে-নাচে-গল্পে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। আজো এসব ছবির গল্প-গান সমানভাবে স্মরণীয়। আশির দশকের পর থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের একটি বাঁকবদল ঘটে। অতিবাণিজ্যিক হতে গিয়ে কিছু ছবি নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। তাও এ সময় বেশকিছু শিল্পমানের ছবি নির্মিত হয়। চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস‘, বুলবুল আহমেদের ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’ এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কিছু শিল্পমানের ছবি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের খারাপ সময় শুরু হয় নব্বই দশকের পর থেকে। অতি বাণিজ্যিক হতে গিয়ে কিছু পরিচালক ভারত, মাদ্রাজের ছবি নকল করতে শুরু করেন। তারপর অশ্লীলতায় ছেয়ে যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। ভালো, শিক্ষিত গুণী পরিচালকরা এ সময় মান বাঁচাতে চলচ্চিত্র থেকে সরে পড়েন। এ সময় আরো বেশিসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী চলচ্চিত্র জগতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে বসেন। সে সময়ই দ্রুত কেটেও যায়। সকলের সচেতন প্রয়াসে, আন্দোলনে আবারো একটি নতুন দিন ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপর বাংলাদেশের গুণী চলচ্চিত্র শিল্পী-পরিচালক-প্রযোজকরা। এর মধ্যে আবির্ভূত হয়েছেন নতুন কিছু গুণী পরিচালক, যারা নিজেদের সংস্কৃতির আলোকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জমান। প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন। তিনি বললেন, অশুভ কোনোদিনই চিরকাল স্থায়ী না। শুভদিন আসবেই। আলো আসবেই। নতুনদের ওপর আমি অনেক আশাবাদী।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক মাসুদ পারভেজ রুবেল। তিনিও জানালেন নিজের আশাবাদের কথা। বললেন, সবার সমন্বয়েই ভালো কিছু হবে। পরিচালক শাহ আলম কিরণ বহু দিন ধরেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত। কাছ থেকে দেখেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উত্থান-পতন। তিনি বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার দর্শকদের আমার চেনাজানা গান-গল্প-সংস্কৃতি না দিতে পারব ততদিন আমরা আমাদের দর্শকদের হলে ফিরিয়ে আনতে পারব না। এ কথা প্রত্যেকেই স্বীকার করে, নিজস্ব সংস্কৃতি ছাড়া কোনো দেশের শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রই বিকশিত হয় না। আশার কথা, আবারো দেখা যাচ্ছে সেই সোনালি দিনের হাতছানি।
মুখ ও মুখোশ : ‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) প্রথম স্থানীয়ভাবে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র। ছবিটির পরিচালক, প্রযোজক ও রচয়িতা আবদুল জব্বার খান এবং সুরকার সমর দাস। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন পূর্ণিমা সেন, সাইফুদ্দিন, বিনয় বিশ্বাস, জব্বার, ইনাম আহমেদ, জহরত আরা প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট তারিখে মুক্তি পায়। আবদুল জব্বার খানের ‘ডাকাত’ নাটক হতে চলচ্চিত্রটির কাহিনী নেওয়া। জব্বার খান দুই বছর ধরে ছবিটির কাজ করেন। স্থানীয় অভিনেতারা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিনা পারিশ্রমিকে এই ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫৬ সালে ছবির কাজ শেষ হয়, কিন্তু তিনি ছবিটি নিয়ে প্রথমে ঢাকায় ফেরার অনুমতি পাননি। ‘মুখ ও মুখোশ’র প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে। অল্প দিন পরেই ‘মুখ ও মুখোশ’ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় একযোগে প্রদর্শিত হয়। প্রকৃত অর্থে ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা : ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ বাংলাদেশের পটভূমিতে নির্মিত প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র। এটি পরিচালনা করেন খান আতাউর রহমান। ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন। সময়টাও ছিল ছবিটির ব্যাপারে আবেগ জাগানিয়া। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পথ ধরে দেশ তখন ফুঁসছিল। ফলে স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রগাঢ় হচ্ছিল দেশবাসীর মনে। ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে’ যে ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ দেখা দিয়েছিল, তা কাটানোর একটা স্বপ্নের বীজও যেন বোনা হচ্ছিল শেষ স্বাধীন নবাবের শেষ সংলাপের পথ ধরে। স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত এ ছবিতে ঐতিহাসিক উপাদানের চেয়ে নাটকীয়তা ছিল বেশি। বাঙালি এই ছবিতে খুঁজে পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। ছবিটি মুক্তির পর অভিনেতা আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভুবনে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের বাংলার মুকুটহীন নবাব খ্যাতি লাভ করেন।
জীবন থেকে নেয়া : ‘জীবন থেকে নেয়া’ সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। জহির রায়হান পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্ভর করে ছবিটি নির্মিত হয়েছিল একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে। একটি পরিবারের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে একটি দেশের রাজনীতি। অসামান্য সেই ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন খান আতা, রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আমজাদ হোসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি তখনো জাতীয়সংগীত হয়নি, বাংলাদেশ জন্মের আগেই এ গানটির অপূর্ব ব্যবহার করেছিলেন জহির রায়হান। অপূর্ব ব্যবহার হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লোহকপাট’ গানটিরও। এখনো ছবিটি প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে টেলিভিশনে দেখানো হয়।
সারেং বউ : শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৮ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘সারেং বউ’। নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের এক নারীর জীবনযুদ্ধের দলিল ‘সারেং বউ’। আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ছবিটিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের এক নারীর জীবন সংগ্রাম স্থান পেয়েছে। এ ছবিতে সংগ্রামী নারী নবিতুনের চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান কবরী। কদম সারেং চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন ফারুক। লন্দু মোড়লের চরিত্রে ছিলেন আরিফুল হক। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন গোলাম মোস্তফা, জহিরুল হক, নাজমুল হুদা বাচ্চু, বাবর, দারাশিকো প্রমুখ। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে যেমন দারুণ সফল হয় তেমনি সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পায়। ‘সারেং বউ’ উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উঠে আসে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নারীর সংগ্রামের বহুমুখী চিত্র। এতে আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়।
দেবদাস : বাঙালির প্রেমের অমর আখ্যান ‘দেবদাস’। ‘দেবদাস’-এ ভালোবাসার যে করুণ, সরল, সর্বজয়ী ও আবেগী চিত্রায়ণ রয়েছে তার তুলনা অন্য কোনো লেখায় পাওয়া বিরল বলেই যুগে যুগে রুপালি পর্দায় দর্শক-হূদয়কে জয় করেছে বাঙালির প্রেমের প্রতীক দেবদাস ও পার্বতী। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ অবলম্বনে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় কলকাতায় ১৯২৭ সালে। নির্বাক এই ছবিটি পরিচালনা করেন নরেশ মিত্র। ১৯৩৫ সালে কলকাতায় আবার নির্মিত হয় সবাক ‘দেবদাস’। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘দেবদাস’। এ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন বুলবুল আহমেদ, পারু ছিলেন কবরী সারোয়ার এবং চন্দ্রমুখী ছিলেন আনোয়ারা। চুনিলালের ভূমিকায় ছিলেন রহমান। বাংলাদেশে দুর্দান্ত বাণিজ্যিক সাফল্য পায় ছবিটি। ২০১৩ সালে চাষী নজরুল ইসলাম নতুনভাবে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন। শরৎচন্দ্রের পর যুগ পাল্টে গেলেও দেবদাসের ভালোবাসা, অভিমান ও আবেগের আবেদন চিরকালীন।
বেদের মেয়ে জোসনা : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি। প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ উপকথানির্ভর এ চলচ্চিত্র বাংলার মানুষের মনপ্রাণ ছুঁয়ে গেছে। এক রাজপুত্রের সঙ্গে বেদে মেয়ের প্রেম, লোকসঙ্গীতের অনন্য ব্যবহার, তার সঙ্গে সাজপোশাকের বাহারি উপস্থাপন, সবমিলিয়ে এ গল্প চিরকালীন বাংলাকে উপস্থাপন করেছে নতুন করে। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন তোজাম্মেল হক বকুল। অভিনয় করেছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, অঞ্জু ঘোষ। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। মাসের পর মাস জুড়ে ছবিটি একেকটি সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়। সে সময় দূর-দূরান্তর থেকে নৌকা করে, গরুর গাড়িতে করে এ ছবি দেখতে এসে টিকেট না পেয়ে হলের সামনে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘর বানিয়ে থেকেছে দর্শকরা।
আগুনের পরশমণি : ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ ছবিটি। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ছবিটি কয়েকটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘আগুনের পরশমণি’ অনন্য একটি ছবি। ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরনো ঢাকার মধ্যবিত্ত একটি পরিবারকে ঘিরে। মতিন সাহেবের পরিবারে স্ত্রী আর দুই মেয়ে। এক দিন তাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত এক গেরিলা যোদ্ধা। বদি। মতিন সাহেবের বড় মেয়ে রাত্রির সঙ্গে তার একটা গোপন গভীর প্রণয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অপরাশন করতে গিয়ে এক রাতে বদি গুলি খেয়ে বাড়ি ফিরে। সারা রাত আহত বদিকে নিয়ে পুরো পরিবারটি জেগে বসে থাকবে। রাত্রি আশা করে বদি বাঁচবেই, আলো আসবেই। পরদিন ভোরের আলোয় সে বদির হাতটি আলোতে মেলে ধরে। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, ডলি জহুর এবং শিলা আহমেদ।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত : বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ একটি মাইলফলক ছবি। সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত এ ছবিতেই প্রথম অভিষেক ঘটে সালমান শাহ ও মৌসুমীর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য নতুন একটি যুগের সূচনা হয়। নাচ-গান ও গল্পে আসে বৈচিত্র্য। তার সঙ্গে আধুনিক ফ্যাশন সংযুক্ত হয় চলচ্চিত্রে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। জুটি প্রথার ক্ষেত্রেও আসে নতুন একটি চমক। সালমান শাহ ও মৌসুমী জুটি বেঁধে একসঙ্গে কয়েকটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দেন দর্শকদের। ব্যাপক জনপ্রিয়তার পর সালমান শাহর হঠাৎ মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের উত্থানকে অনেকটা স্তিমিত করে দেয়। এখনো ছবিটি সমান দর্শকপ্রিয়। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ভারতের ‘কেয়ামত সে কেয়ামত’ ছবির কাহিনী অবলম্বনে।
দীপু নাম্বার টু : মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত এ ছবিটি মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘দীপু নাম্বার টু’ শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে। ছবিটি শিশু-কিশোরদের মনে দারুণ রেখাপাত করে। বাবার চাকরির কারণে প্রতি বছর স্কুল পাল্টাতে হয় দীপুর। একেক জায়গায় গিয়ে তার একেকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। বছর শেষে আবার স্কুল পাল্টাতে হয়। তেমনই এক স্কুলে পড়তে গিয়ে তারেকের সঙ্গে প্রথমে তার শত্রুতা হয়, পরে তা রূপ নেয় অসাধারণ এক বন্ধুত্বে। ‘দীপু নাম্বার টু’ মূলত বন্ধুত্বেরই গল্প। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত এ ছবিটি প্রচুর ব্যবসা সফল হয়, তার সঙ্গে রুচিশীল দর্শকরাও হলে ফিরে আসে। শিশুদের নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় কম। সেদিন থেকে এ ছবিটি অসাধারণ একটি সংযোজন।
মাটির ময়না : তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ছবিটি নানা দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে এটি যেমন দর্শকনন্দিত তেমনি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবেও সমাদৃত। ছবিটি নানা দেশি ও বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রশংসিত হয়েছে। এটি মুক্তি পায় ২০০২ সালে। স্বাধীনতার সময় আনু ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে ছবিটির গল্প আবর্তিত। গ্রামীণ ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এতে আত্মপ্রকাশ করেছে তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনা। তারেক মাসুদ তার জীবনস্মৃতি থেকেই ছবিটি নির্মাণ করেছেন বলে জানিয়েছেন। আবহমান বাংলা ছবিটিতে উপস্থাপিত হয়েছে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দনভাবে। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন নূরুল ইসলাম বাবলু, রাসেল ফরাজী, রোকেয়া প্রাচী, শোয়েব ইসলাম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লামিসা রিমঝিম প্রমুখ। ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে কান ফিল্ম ফেস্টিভালের জন্য নির্বাচিত হয় এবং ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগের সূচনা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
মনপুরা : সম্পূর্ণ গ্রামবাংলার পটভূমিতে নির্মিত পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পারিবারিক ও প্রেমের গল্পের চলচ্চিত্র ‘মনপুরা’ মুক্তি পায় ২০০৯ সালে। তবে এটি মুক্তির আগেই অ্যালবাম আকারে মুক্তি দেওয়া হয় এর গানগুলো। ‘নিথুয়া পাথারে’, ‘আগে যদি জানতাম রে বন্ধু’, কিংবা ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানগুলো রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নির্মাতার কল্পিত দৃশ্যগুলো পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন চঞ্চল চৌধুরী, ফারহানা মিলি, ফজলুর রহমান বাবু আর মামুনুর রশিদের মতো শক্তিশালী অভিনয় শিল্পীরা। গত দুই তিন দশকে বাংলাদেশে যতগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে যে কয়েকটি চলচ্চিত্র আমাদের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে, ‘মনপুরা’ সেগুলোর অন্যতম। সঙ্গীত ‘মনপুরা’র সফলতম দিক। এ ছাড়া এর আবহ সঙ্গীতও বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এমনটি সচরাচর ঘটতে দেখা যায় না। ২০০৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ৫টি বিভাগে পুরস্কার জেতে ছবিটি।
এটিএম শামসুজ্জামান
বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ক্রমশ উত্তরণের দিকে যাচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে নতুন কিছু তরুণ পরিচালক এসেছেন, যারা দেশ-জাতি, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছেন। তাদের ওপর আমি অনেক আশাবাদী। আমি আশীর্বাদ করি তারা এগিয়ে যাক। আমি থাকি আর না থাকি, আমাদের চলচ্চিত্রে আবার সুদিন ফিরে আসবে। আসবেই। এটাই জগতের নিয়ম। অশুভ বেশিদিন বাসা বেঁধে থাকতে পারে না। একদিন আমাদের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী দিন ছিল, মাঝখানে কিছুদিন খুব খারাপ গেছে, এখন আবার সুদিন ফিরে আসছে। আমি হতাশাবাদী মানুষ নই, আমি আশাবাদী মানুষ। আশা নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। আশা শেষ তো সবই শেষ। এখন দরকার আমাদের সমন্বয় আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। ব্যস, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে সকাল ১০টার মধ্যে জমজমাট এক হাট বসে যেত এফডিসিতে, একটার পর একটা গাড়ি আউটডোরে বেরোচ্ছে, ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি চলছে, এখন তো সেই অবস্থা নেই। আমি বিশ্বাস করি আবার সেইদিন ফিরে আসবে।
শাহ আলম কিরণ
আমাদের অবক্ষয়টা শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে। তখন ভারতীয় সংস্কৃতি আসতে শুরু করে। আমরা বম্বের (মুম্বাই) নকলে ছবি বানাতে শুরু করলাম। পরে মাদ্রাজেরও নকল করেছি। আস্তে আস্তে অশ্লীলতার দিকে চলে গেছি। নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে গেছি। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রের সোনালি অধ্যায় হচ্ছে তার নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচয়। সেই জহির রায়হান, কাজী জহির, কামাল আহমেদ থেকে যদি শুরু করি খান আতা, নারায়ণ ঘোষ মিতা তারা কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতির ছবি বানিয়েই জনপ্রিয় হয়েছেন। আশার কথা, এখন আবার সেই সংস্কৃতিটা ফিরে আসছে। মানুষ বুঝতে পারছে আজগুবি নকল ছবি বানিয়ে আর চলবে না। তরুণ পরিচালকরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি সচেতন হচ্ছে। আরেকটা ব্যাপার, চলচ্চিত্র একটা প্রযুক্তিগত মাধ্যম। আমাদের প্রযুক্তি একটু পিছিয়ে আছে। আমাদের এখন ২৫০ থেকে ৩০০ ডিজিটাল সিনেমা হল খুব জরুরি হয়ে গেছে। সরকার যদি এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের সবার সহযোগিতায় চলচ্চিত্রের উন্নতি অবশ্যই হবে।
মাসুম পারভেজ রুবেল
আমাদের মূল সমস্যা আমাদের কোনোকিছুতেই সমন্বয় নেই। এখনকার সবচেয়ে বড় সমস্যা সবাই নিজেকে বিরাট কিছু মনে করে। অথচ করতে পারছে না কিছুই। আগে যে আমাদের চলচ্চিত্রে ভালো কিছু হয়েছে তার কারণ সবাই ডেডিকেটেড ছিলেন। রাজ্জাক ভাই, আলমগীর ভাই, কাঞ্চন ভাই, ফারুক ভাই, ভাইয়া (সোহেল রানা) সবাই যার যার জায়গা থেকে চলচ্চিত্রকে দিয়েছেন। কিন্তু এখন প্রবণতা দেওয়ার নয়, নেওয়ার। কে কত দ্রুত টাকা-পয়সা, ফ্ল্যাট, গাড়ি করতে পারবে তারই প্রতিযোগিতা। এসে একটু নামদাম করলেই এখন ১০ লাখ, ২০ লাখ সম্মানী চেয়ে বসে। অথচ পুরো ইন্ডাস্ট্রিটার কথা ভাবে না। যে জায়গাতেই আপনি থাকেন সে জায়গাটাকে আগে ভালোবাসতে হবে। কিন্তু, এখন ইন্ডাস্ট্রিটাকে আখের ছোবড়া বানিয়ে ফেলছে চিপে। যে যতটুকু চিপে রস নিতে পারে। এ থেকে উত্তরণের একটাই পথ শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতি সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা উন্নত করবই- এ রকম একটা প্রত্যয় থাকতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র
স্বদেশের যুদ্ধ নিয়ে যত দেশে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশে। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এদেশে এত বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে যে, দেশের বাইরেও তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার ভাষায়, আগামী প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গৌরব, গর্ব আর বেদনাগাথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পালন করে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এটি বাংলাদেশের জন্য সত্যিই অহঙ্কারের বিষয়।
স্বাধীনতার পর পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারোজন’ নির্মাণ করেন। এটি শুধু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রথম চলচ্চিত্রই ছিল না, স্বাধীন দেশে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রও ছিল। ছবির অধিকাংশ কলাকুশলীই ছিলেন রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ১১ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত গেরিলা দলের পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানের ঘটনা এ ছবিতে তুলে ধরা হয়। এই এগারোজনের দশজনই ছিলেন বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধা এবং তারা কেউ পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। ১১ দফার ছাত্র আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে প্রতীকী অর্থে চলচ্চিত্রের নামকরণ করা হয় ‘ওরা ১১ জন’। দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ওরা এগারজনসহ চারটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এগুলো হলো- চাষী নজরুল ইসলামের ওরা ১১ জন, সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, মমতাজ আলীর রক্তাক্ত বাংলা এবং আনন্দের বাঘা বাঙ্গালী।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে আসছে। দেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রগুলোর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সিনেমাগুলো। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে অর্ধ শতাধিক চলচ্চিত্র। এগুলোর মধ্যে জয়বাংলা, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, ধীরে বহে মেঘনা, আবার তোরা মানুষ হ, আলোর মিছিল, কলমিলতা, একাত্তরের যীশু, আগুনের পরশমণি, মুক্তির গান, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, মাটির ময়না, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, খেলাঘর, আমার বন্ধু রাশেদ, গেরিলা, মেঘমাল্লা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর প্রায় সবই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং পুরস্কার জিতেছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মিত ছবির সংখ্যা ছয়টি। এগুলো হলো- ‘এইতো প্রেম’, ‘হরিযুপিয়া’, শোভনের স্বাধীনতা, একাত্তরের ক্ষুদিরাম, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ ও ‘অনিল বাগচীর একদিন’।
আমাদের এফডিসি...
এফডিসিতে ঢুকতে দেখা গেল দাড়োয়ানরা বসে ঝিমুচ্ছেন। গেটের সামনেও মানুষজন নেই। অথচ একসময় এফডিসির সামনে ভিড় করে থাকত অসংখ্য মানুষ। তারকারা কে কখন ঢুকছেন বেরোচ্ছেন গাড়ির ভেতর তাদের একটু উঁকি মেরে দেখার জন্য তারা পাগল হয়ে থাকেন। দাড়োয়ানদের দিন যেত গেটের সামনে থেকে সেই ভিড় সরাতে সরাতে। আজ তার কিছুই নেই। পুরো এফডিসি ফাঁকা। ফ্লোরগুলো শূন্য পড়ে আছে। দু-একটায় মাঝে মাঝে কিছু শুটিং হয়। অথচ এক দিন এই এফডিসি সারাদিনই ছিল রমরমা। তারকারা আসছেন, যাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। সকাল ১০টার মধ্যেই একটার পর একটা গাড়ি আউটডোরে বেরোচ্ছে। অতিরিক্ত শিল্পীরা আরো সকালে এসেই নাম লেখাতে শুরু করত। আজ তার অনেক কিছুই নেই। বাংলা চলচ্চিত্রের সেই সুদিন নেই।
বাংলা চলচ্চিত্রকে উন্নয়নের লক্ষ্যে আলাদা একটি স্টুডিও প্রয়োজন দেখা দেয় দেশ বিভাগের পর পরই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এক বছর পর ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের পুরোধা নাজীর আহমদ পরিচালিত ‘সালামত’ ছবিটি মুক্তি পেলে ঢাকায় চলচ্চিত্র স্টুডিও গড়ে তোলার দাবি ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন ঢাকায় সরকারি ফিল্ম ডিভিশন ল্যাবরেটরির যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এতে পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্র নির্মাণের কোনো সুবিধা ছিল না। সমস্যাটি তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের গোচরে আনা হলে ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের শেষ অধিবেশনের দিন তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন বিল’ উত্থাপন করেন। বিলটি সামান্য সংশোধনীর পর বিনা বাধায় আইন পরিষদে পাস হয়। এর এক বছর পরই ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ (ইপিএফডিসি)। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ (বিএফডিসি)। এফডিসি হচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নির্মাতাদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কৃতিত্ব জহির রায়হানের। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রযোজনা করেন। আলমগীর কবির নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। চাষী নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিত্রায়ণ করেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২)।
এফডিসিকে এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে সাজানোর জন্য তোড়জোড় ও আন্দোলন চলছে। এফডিসি যেন পরিত্যক্ত ভূমি না হয়ে যায়, এটি যেন আবার সচল হয়ে ওঠে এ নিয়ে একযোগে আন্দোলন করছেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা।