কৃষি অর্থনীতি

বাংলার কালো মানিক : ব্ল্যাক বেঙ্গল

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৮ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্বে হাতে গোনা যে চার থেকে পাঁচটি ছাগলের জাতের এখনো সংকরায়ণ হয়নি, তার অন্যতম জাতটি হলো ব্ল্যাক বেঙ্গল। বলা বাহুল্য, এই জাতটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রেখেছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। ছাগল পালন বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বিশ্বে স্বীকৃত সেরা জাতের ব্ল্যাক বেঙ্গল নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন এস এম মুকুল

 

দেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি ছাগল পালিত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনের সাফল্যে উজ্জীবিত হচ্ছেন আশপাশের অন্যান্য এলাকার জনগণ। গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের এই ছাগলের নবজাতকের মৃত্যুহার কম। আর এরা বছরে দুবার কমপক্ষে চারটি বাচ্চা দেয়। অন্য জাতগুলোর তুলনায় এই জাতের ছাগলের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এই ছাগল পালনে বড় চারণভূমির প্রয়োজন নেই।

 

বাড়ছে খামারভিত্তিক ছাগল পালন 

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ছাগল পালন বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তরুণরা গড়ে তুলছে ব্ল্যাক বেঙ্গলের খামার। সফলতা পাওয়ায় ব্ল্যাক বেঙ্গলের খামারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে আশাব্যঞ্জক হারে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে, সারা দেশে এখন দুই কোটি ৬০ লাখের অধিক ছাগল আছে যার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। আশার খবরটি হচ্ছে, প্রতিবছরই ব্ল্যাক বেঙ্গলের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে এই ছাগল পালনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এক কোটি মানুষ। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটা একটা রেকর্ড। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় ২০০৮ সালে মাচায় ছাগল পালনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ছাগলের মৃত্যুহার কমানোর জন্য ‘লিফট’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় দেশের ১৮ জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২১টি ব্রিডিং ফার্ম। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কীভাবে লালন-পালন করতে হয়, পিকেএসএফ তাদের সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে তা শিখিয়ে দিচ্ছে কৃষকদের। ইতোমধ্যে ছাগলের মৃত্যুহার চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে আনা সম্ভব হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ শতাংশ এবং সারা দেশে উপজেলা প্রতি ছাগলের সংখ্যা গড়ে ১৭১ শতাংশ বেড়েছে।

 

বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের (আইএইএ) সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুযায়ী, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। বাংলাদেশের নিজস্ব এই জাতটির জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে দীর্ঘ ৯ বছর গবেষণা করেছে জাতিসংঘের আণবিক শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থা দুটি বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপর গবেষণা করে ব্ল্যাক বেঙ্গলকে অন্যতম সেরা জাত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০৭ সালের ২০ মার্চ জাতিসংঘের সংবাদ সংস্থা ইউএন নিউজে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গলের সুনাম। সেই প্রতিবেদনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। কিন্তু এখানেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাণিসম্পদ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বসতি।’

সে বছরই আইএইএর ওয়েবসাইটে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বসেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদিও বাংলাদেশের সেই দরিদ্রাবস্থা এখন আর নেই। তবে বিশ্বসেরা এই জাতের ছাগলের উৎপাদন ও গবেষণায় উত্তরোত্তর সফলতা অর্জন করছে বাংলাদেশ। তবে এফএও’র গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুর্বল দিকটি হলো দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-ওজন এবং দুধের পরিমাণ অন্যান্য ছাগলের চেয়ে কম। কেননা আফ্রিকার মাসাই, ভারতের যমুনা পাড়ি এবং চীনা জাতের ছাগলের মাংস ও দুধের পরিমাণ ব্ল্যাক বেঙ্গলের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। তবে ওই তিন জাতের ছাগলের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়। অপরপক্ষে ব্ল্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার বিচারে ব্ল্যাক বেঙ্গলকে সেরা জাত হিসেবে নির্বাচন করেছেন। আরো আশার খবরটি হলো, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার অপেক্ষায়। ওই স্বীকৃতি মিললে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল হবে শুধুই বাংলাদেশের।

 

দিনবদলে ব্ল্যাক বেঙ্গল 

গ্রামাঞ্চলে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ব্ল্যাক বেঙ্গল। অনুসন্ধানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে এ জাতের ছাগল প্রতিপালনে উৎসাহিত হচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও অন্যতম আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন সহায়ক ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে বাণিজ্যিকভাবেও ব্ল্যাক বেঙ্গলের খামার হতে পারে সবচেয়ে লাভজন উদ্যোগ। খাসির মাংস খেতে খুবই সুস্বাদু। ছাগলের লোম থেকে তৈরি হয় উন্নত মানের পশম। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের এ ছাগল খুবই রোগ প্রতিরোধী এবং সহজে রোগবালাই হয় না। চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার গড়ে তুলেছে। প্রায় সবার মুখেই এখন হাসির ঝিলিক। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চা উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেশি এবং এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে এর উপযোগিতাও অনেক।  ঢাকা, খুলনা ও ময়মনসিংহ বিভাগে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন ও উৎপাদন হয়। ভৌগোলিকভাবে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও বৃহত্তর যশোর জেলাকে ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনে সবচেয়ে উপযোগী স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লক্ষণীয় বিষয়টি হলো- মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এ জাতের ছাগল পালন বেশি হয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল থেকে পাওয়া যায় উন্নত মানের চামড়া। পৃথিবীর যে কোনো জাতের ছাগলের চামড়া থেকে ব্ল্যাক বেঙ্গলের চামড়া গুণগত মানসম্পন্ন। ইতোমধ্যে এই জাতের ছাগলের চামড়া বিশ্ববাজারে কুষ্টিয়া গ্রেড হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে।

 

ভূমিকা রাখবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে

বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ছাগলের ভান্ডার। প্রতিবছর দেশটি এ-জাতীয় ছাগল থেকে প্রায় সোয়া লাখ টন মাংস পেয়ে থাকে, যা মোট মাংসের প্রায় ২৫ শতাংশ। এ জাতের ছাগল যেমন দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে, তেমনি দ্রুত বড় হয়। বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বেশি। এর চামড়া এত উন্নতমানের যে, বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ব্যবহূত হয়। এ জাতের খামারে তৃতীয় বছরেই ছাগল বিক্রিযোগ্য হয়। খামারিদের অনেকের মতে, ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনে সরকার যদি যথাযথ মনোযোগ ও গুরুত্ব দেয়, তাহলে দেশের সব জেলার প্রতিটি গ্রামের মানুষ সহজেই খামার গড়ে তুলে স্বাবলম্বনের সুযোগ গ্রহণ করবে।

 

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads