বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

ফাইল ছবি

মুক্তমত

তারুণ্য ভাবনা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

  • প্রকাশিত ২৯ নভেম্বর, ২০১৯

আমরা অবধারিতভাবেই সমগ্র পুঁজিবাদের দিকেই অগ্রসর হয়েছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রেণিভেদ স্পষ্ট। অনেকেই এই অসম বণ্টন ও উন্নয়নের জন্য পুঁজিবাদের ঘাড়ে দোষ চাপান। সমতা, সমবণ্টন বা একক নিয়ন্ত্রক যাই বলি না কেন, সব যেন ভোগবাদের কাছে আত্মমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। যেভাবেই হোক নিজেকে ধনী থেকে আরো ধনী করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তা যদি হয় অন্যের ঘাড়ে চড়ে তাহলেও পিছপা হচ্ছি না। এর পেছনের কারণ হিসেবে পরোক্ষভাবে পুঁজিবাদকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সত্যি কি তাই? আজ যেসব দেশ উন্নত সেসব দেশ পুঁজিবাদী হলেও তাদের সমতা এবং ন্যায্যতার সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পুঁজিবাদের পার্থক্য রয়েছে। পুঁজিবাদের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকানোর কোনো কার্যকর অস্ত্রও আমাদের হাতে নেই। কারণ দুর্নীতিসহ আরো কিছু আনুষঙ্গিক নিয়ামক তা হতে দিচ্ছে না। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার আজকের যে গতি-প্রকৃতি তা পুঁজিবাদের সামগ্রিক প্রসারের ফলে তৈরি হয়েছে বা সেই ধারা ক্রমেই আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনকে গ্রাস করছে। সম্পদের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। সারা বিশ্বেই সম্পদ এক শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে যা পক্ষপাতমূলক ধনতান্ত্রিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর এরই ফলে ধনীরা ক্রমেই ধনী হচ্ছে আর দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছে। এভাবে অর্থনীতি ধনতান্ত্রিকতার দিকেই ঝুঁকছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আয়-বৈষম্য এবং জীবন ধারণের মানে পার্থক্য। বাজারে তার প্রভাবই লক্ষ করা যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের জীবন ধারণ হয়ে পড়েছে সীমিত। বলা যায়, একটি নির্ধারিত রুটিনমাফিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে এই শ্রেণি। ঠিক একই সময়ে বিলাসিতাও দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে। এটাই পরস্পর বিপরীত চিত্র। ধনতান্ত্রিকতা এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করছে যেখানে ধনিক শ্রেণির সংখ্যা খুব দ্রুতই বাড়ছে। এই ধনিক শ্রেণির বৃদ্ধিতে এশিয়ায় বাংলাদেশও পেছনে নেই।

আমরা এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদের গতিকে অস্বীকার করতে পারি না। আমরা ইতোমধ্যে এর মধ্যে মুখ গুঁজে রয়েছি। কারণ পুঁজিবাদ অর্থই এক ধরনের প্রতিযোগিতা। গোটা বিশ্বেই যখন পুঁজিবাদের ধ্যানধারণা বিকাশ লাভ করতে থাকে তখনই উদ্ভব হয় প্রতিযোগিতার। এই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও দুটি দিক লক্ষণীয়। সমপ্রতিযোগিতা এবং অসম প্রতিযোগিতা। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত ক্ষমতা রয়েছে প্রতিযোগিতাকে বেগবান করতে। কারণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনেই পুঁজিবাদের মূল চর্চা। কিন্তু যদি সেই প্রতিযোগিতা অবৈধ চর্চা হয় তাহলে? তাহলে যা ঘটে তাহলো আচমকা প্রচুর ধন-সম্পদ গড়ে তোলা এবং তার প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উচ্চবিত্তের আসনে আসীন হওয়াটা অবশ্যই খারাপ কিছু নয় বরং তা অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক এবং অন্যকেও তা করতে উৎসাহিত করছে। সেই একই চর্চা যদি অবৈধ উপায়ে বা যেনতেনভাবেই হোক না কেন ধনী হওয়া চাই-ই-চাই, সম্পদের পাহাড় বানানো চাই-ই-চাই; তাহলে যে বিবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে তা থেকে সমাজকে মুক্ত করবে কে? বিশ্বের সব দেশই কমবেশি পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হলেও সব দেশেই পুঁজিপতি হওয়ার যে ধরনের পার্থক্য হয়েছে তা সেই সব দেশের বর্তমান কাঠামোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন উচ্চবিত্ত বাজারে গিয়ে যে পণ্য কিনছে তা কেনার সামর্থ্য কোনো শ্রমিকের থাকে না। তবে সেই শ্রমিক যদি দিন শেষে নির্বিঘ্নে তার প্রয়োজন মিটিয়ে ঘরে ফিরতে পারে তা পুঁজিবাদের নমুনা হলেও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সেই শ্রমিকও পিছিয়ে থাকছে না। বাজারে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির খবরে যারা বেশি আন্দোলিত হয় বা ক্রয়ক্ষমতা বাধ্যতামূলকভাবে কমাতে বাধ্য হয় তাদের সঙ্গে সেই শ্রেণির পার্থক্য রয়েছে যাদের কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না।

পুঁজিবাদ তার চিরাচরিত নিয়মেই বিকশিত হয়েছে এবং যখন পুঁজিবাদকে গ্রহণ করা হয়েছে তখন থেকে বিভাজনও বিকাশ লাভ করেছে। যখন দিন শেষে একজন মানুষ তার উপার্জন দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে না, মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তখন দৈন্য এ ব্যবস্থাকে মানবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পুঁজিই মুখ্য। ক্রমাগত পুঁজি পুঞ্জীভূত করার মাধ্যমে একচেটিয়া ব্যবসায়ের কাঠামোতে দাঁড় করানোতেই পুঁজিবাদের সার্থকতা। মালিকানাধীন ব্যবসা পরিচালনা করার মাধ্যমে ব্যবসায়ের গতিধারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং মূলধনই এর প্রধান লক্ষ্য থাকে। এর ফলে কে পেছনে পরে রইল আর কে প্রতিযোগিতার রাস্তা থেকে ছিটকে গেল তা দেখার অবকাশ থাকে না। একটি লাগামহীন ঘোড়ার রেসের মতো মনে হয়।

যেখানে কেউ মাঝপথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই, কেউ তো সামনে চলেই যায়! ধনতান্ত্রিক এই অর্থব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে বা হচ্ছে। পুঁজিবাদের সমালোচনারও অভাব নেই। আবার পুঁজির পাহাড় বানিয়ে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার মানুষেরও অভাব নেই। ‘ংঁৎারাধষ ভড়ৎ ঃযব ভরঃঃবংঃ’ ইংরেজি এ কথাটি আমরা সবাই জানি। বিশ্ব যে এর জয়জয়কার করছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এত কিছুর মধ্যে থেকেও সমবণ্টন করা যায়, মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়। যা বড় বড় শিল্পোন্নত দেশগুলো করছে। দার্শনিক হার্বাট স্পেনসার তার ‘প্রিন্সিপাল অব বায়োলজি’তে যে ধারণাটির অবতারণা করেন। পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর অথচ চরম এক সত্যকেই তিনি সামনে এনেছেন। যোগ্যতররাই টিকে থাকবে। বাকিরা ছিটকে পড়বে। তাদের দিকে ঘুরে তাকানোর কেউ নেই, সে সময়ও নেই। সবলের কাছে দুর্বলের টিকে থাকার সুযোগ নেই। এটাই পুঁজিবাদের রহস্য। এ রহস্যের মায়াজালেই পৃথিবী বন্দি হয়ে গেছে। সমাজে যে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির তত্ত্ব শুরু হয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে মানুষ নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত রয়েছে। তাই পুঁজিবাদের ক্ষমতা অসীম। কাউকে তা যেমন সাজাতে পারে আবার এদিক-ওদিক হলে তা খুলেও নিতে পারে।

উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থার চালিকাশক্তি হিসেবেই মানুষ পুঁজিকেই বেছে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক কার্ল মার্কস সমাজ ও পুঁজিবাদ নিয়ে যে তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছিলেন, সেগুলো আমাদের সমাজে কতটুকু কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বহু বহু বছর আগে তিনি যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন আজ আমরা তা অনেকটাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

আমাদের পুঁজিবাদ নিয়ে আপত্তি কোথায়? প্রতিযোগিতায়? প্রতিযোগিতা তো সৃষ্টির শুরু থেকেই চলছে। আমাদের আপত্তির জায়গা হলো প্রতিযোগিতার মধ্যেও সমান সুযোগ-সুবিধার ভারসাম্য ঠিক রাখা। বর্তমান ব্যবস্থায় যেমন অর্থের মানদণ্ডে শ্রেণিভেদ তৈরি হচ্ছে এবং সেই শ্রেণিভেদে প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে অসম বণ্টন হচ্ছে। ভোগবিলাসের বিপরীতে রয়েছে কোনোমতে জীবনযাপন করা মানুষের সংখ্যা। মাঝে মধ্যবিত্ত যাদের বলা হচ্ছে, তারা প্রতিনিয়তই জীবনযাপনের ভারে পিষে মরছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাই আজকের উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক। রং-চংয়ে ভরা বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণ করাই লক্ষ্য। মার্কেট হিট বলে যে কথা প্রচলিত তা তো এই বাহারি বিজ্ঞাপনের কারসাজি। আর যার সে ক্ষমতা নেই সে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রেণিভেদ তৈরি করার এই সংকট যে কোনো উপায়ে (বিশেষ করে অসাধু উপায়ে) পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে। তা সমাজে বেশ রমরমাভাবেই চলছে। স্বার্থ যেহেতু সামষ্টিক নয় বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক তাই একচেটিয়া বাজার দখল এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপকে আরো এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পুঁজিবাদের নতুন করে গ্রাস করার কিছু নেই। তবে এর জন্য পুঁজিবাদ নয় বরং আমাদের সীমাহীন লোভ এবং লোভের ফলে দুর্নীতির বিস্তার, অন্যকে ঠকানোর প্রবণতা, অবৈধ উপায় অবলম্বন করে ধনিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রবণতা এসবই দায়ী। পুঁজির সঠিক ব্যবহার যারা করতে পেরেছে তারা ঠিকই মানুষের অধিকার নিশ্চিতের দিকেই অগ্রসর হয়েছে।

লেখক :মুখলেসুর রহমান

শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

muklasurrahmaniu@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads