আব্দুর রউফ
ঐক্য, সংগ্রাম, গৌরব, ঐতিহ্য ও আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে পথচলার দীর্ঘ চার দশক পার করছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। এই পথচলায় ছাত্র মৈত্রীর সংগ্রামের পথটা কখনোই সহজ ছিল না। বহু আত্মত্যাগ, দীর্ঘ সংগ্রাম ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজকের ছাত্র মৈত্রী। মেহনতি মানুষের শিক্ষার অধিকার আদায়ের দিশা নিয়ে ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক ঐক্যের মোহনায় গঠিত হয় বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।
বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী এদেশের ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। ‘মেহনতি জনতার সঙ্গে একাত্ম হও’ এই স্লোগানকে ধারণ করে মেহনতি জনতাসহ সবার শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাহসী ভূমিকার ইতিহাস রচনা করে চলছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। ১৯৫২ সালে ২৬ এপ্রিল মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’। তারই ধারাবাহিকতা ও উত্তরাধিকার আজকের বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।
পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ইউনিয়ন ষাট দশকে এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিল। হঠাৎ কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মহাবিতর্কে থমকে দাঁড়ায়। বিভক্ত হয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। আপসকামিতা ও সুবিধাবাদকে পরিহার করে সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আপসহীনভাবে এগিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর পূর্বসূরি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ আমাদেরই গর্ব। তৎপরবর্তী ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আশির দশকজুড়ে স্বৈরশাসন উৎখাত ও পরবর্তীকালের সব প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইয়ে অসংখ্য শহীদ আমাদের পথচলার অনুপ্রেরণা।
এদেশের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ধারাবাহিক ভাঙন আমাদের ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যকে নিঃশেষ করেছিল। সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের এরকম ক্রান্তিলগ্নে, ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন চারটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন— জাতীয় ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্র দলের দুটি অংশ এবং বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী নামে সংগঠন গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ধারাকে আরো শক্তিশালী করা। অতীতের সব ভুল-ভ্রান্তিকে সচেতনতার সঙ্গে এড়িয়ে ঐক্যের ধারাবাহিক সংগ্রামে ১৯৮১ সালে ‘জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নে’র একটি অংশ, ১৯৮৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নে’র একটি অংশ মিলিত হয়ে ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী’ নাম ধারণ করে। পরে ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল ‘বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নে’র আরেকটি অংশের ঐক্যের মধ্য দিয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’ সুস্থধারার ছাত্র আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৯৮৮ সালের ২১ নভেম্বর ঐক্যের মোহনায় মিলেছে ‘জাতীয় ছাত্র সংসদ’। ঐক্যের ধারায় বিকশিত ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন’ ১৯৯২ সালের ২৩-২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনকে আরো গতিশীল করে। উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’ ও ‘বাংলা ছাত্র ইউনিয়নে’র খণ্ডিত অংশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন’। ১৯৮৭ সালের আগস্টে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নে’র সঙ্গে মিলিত হয় ‘ছাত্র ঐক্য ফোরাম’।
ধারাবাহিক ভাঙন ও ঐক্যের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী কখনো শিক্ষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে একবিন্দু পিছপা হয়নি। তাই বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর ৪০ বছরের ইতিহাস শুধুই সংগ্রামের ও আত্মত্যাগের। ‘মেহনতি জনতার সঙ্গে একাত্ম হও’ এই স্লোগানকে ধারণ করে ছাত্র মৈত্রী একদিকে দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষা-কাজের সংগ্রাম এবং অপরদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা- সামরিক স্বৈরাচার- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ে নিয়োজিত আছে।
একাত্তরে পরাজিত ঘাতক মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে ছাত্র মৈত্রীর বিরোচিত লড়াই এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায় রচনা করেছে। ছাত্র মৈত্রী লড়াই-সংগ্রামের পথে এখনো অবিচল। ৪০ বছরের এই সংগ্রামী পথচলায় ছাত্র মৈত্রী অসংখ্য নেতাকর্মী জীবন বিসর্জন দিয়েছে। অনেকেই এই সংগ্রামে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র মৈত্রী হারিয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শহীদ জামিল আক্তার রতনকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জুবায়ের চৌধুরী রিমুকে, শহীদ দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ফারুকুজ্জামান ফারুককে, যশোরের শহীদ আইয়ুব হোসেনকে, রাজবাড়ীর শহীদ বনি আমিন পান্নাকে, শহীদ আতিকুল বারীকে, ঝিনাইদহের শহীদ রাজু আহম্মেদ বাবলুকে, পাবনার শহীদ আসলামকে, ঢাকা মহানগরের শহীদ আশরাফুল ইসলাম নাসিমকে, শহীদ রেজাউল করিম সেলিমকে, বরিশালের শহীদ শামীম আহমেদকে, সর্বশেষ রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শহীদ রেজওয়ানুল ইসলাম চৌধুরী সানিকে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবদুল মোতালেব জুয়েলকে।
ধারাবাহিক ঐক্যের প্রক্রিয়ায় মেহনতি জনতার সঙ্গে একাত্ম হওয়া এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার নিয়ে সমাজ বিপ্লবের সহযোগী শক্তি হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের ঐক্যের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী লড়াইয়ের পতাকা হাতে এগিয়ে চলছে। এই লড়াই সংগ্রামের মিছিলে আরো এগিয়ে যাক। মানুষের কথা বলুক। দ্রোহ করুক সমস্ত অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। হারানোর কিছু নেই। ফেরার পথ নেই। এই মিছিল দীর্ঘ হোক।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা