‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নগর ফিরিয়ে দিয়ে অরণ্য চেয়েছিলেন। ইট-পাথর আর কাঠ-লোহার শহরের বদলে চেয়েছিলেন পুণ্যচ্ছায়ারাশির তপোবন। সেখানেই তিনি পৃথিবীর হূদয়ের স্পন্দন অনুভব করতে চেয়েছিলেন। শতবর্ষ আগে সভ্যতার বিকাশের প্রতিক্রিয়ায় প্রকৃতিবিনাশের আশঙ্কায়ই কবি ফিরে চেয়েছিলেন অরণ্য, চেয়েছিলেন গাছের বিস্তার। আর আজ সভ্যতার ‘বিকৃত বিকাশে’ মুমূর্ষু প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই গাছের প্রতি দরদ দেখানোর সময় এসেছে। নিজেদের স্বার্থেই গাছ লাগানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে মানুষ। কথিত ‘সভ্যতার স্রোতে’ গা ভাসানো বিশ্বের অনেক দেশই সবুজের সংস্পর্শ পেতে নিচ্ছে নানা উদ্যোগ। বাংলাদেশে প্রতিবছর বর্ষাকালে উদযাপিত হয় বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ। তবে গাছের চারা কেনা, বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নেওয়া, রোপণ করা আর প্রাথমিক পরিচর্যার অনীহায় অনেকের আর গাছ লাগানো হয়ে ওঠে না। কিন্তু প্রাচীন চাষাবাদের সিডবল পদ্ধতি এই অনীহাকে কাটিয়ে গাছ লাগানোয় আগ্রহের জন্ম দিতে পারে, স্কুল পর্যায়ে হতে পারে উৎসব।
সিডবল বা বীজপিণ্ড
চাষাবাদে বা বৃক্ষরোপণে সিডবল বা বীজপিণ্ড অতি প্রাচীন এক প্রযুক্তি হলেও আধুনিক যুগে কম খরচে, কম সময়ে বনায়ন বা বৃক্ষরোপণের এই পদ্ধতিটি নতুন করে সবার সামনে নিয়ে আসেন প্রাকৃতিক কৃষি ধারণার স্রষ্টা ও জাপানি দার্শনিক মাসানুবো ফুকুওকা। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফুকুওকার আকর্ষণের বিষয় ছিল বিজ্ঞান। উচ্চতর শিক্ষা শেষে ফুকুওকা প্রকৃতির টানে ফিরে যান জাপানে। এরপর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ শুরু করেন। জমিতে কোনো ধরনের লাঙল না চালিয়েই চলতি ফসলের মধ্যেই আগামী মৌসুমের ফসলের বীজ বপন করতেন।
সমতলের জমিতে এই পদ্ধতিটি কার্যকর হলেও পাহাড়ি ঊষর জমিতে তিনি প্রয়োগ করেন ভিন্ন প্রযুক্তি। উর্বর মাটির সঙ্গে নানা জাতের ফসলের বীজ মিশিয়ে তৈরি করেন মার্বেলের বলের মতো মাটির বল। পরে সেটি গুলতি বা অন্য কিছুর মাধ্যমে ছুড়ে দেন দূরে। মাটির ভেতর থাকা বীজগুলো সময়-সুযোগমতো অঙ্কুরিত হয়ে পরিণত হয় গাছে।
বনায়নে সিডবল
ফুকুওকার দেখানো পথে পৃথিবীর অনেক দেশ আর শহরেই বনায়নের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সিডবল। জাপান, ভারত, কেনিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই এই প্রযুক্তিটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গত ১৮ মে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ২৫ কলেজ শিক্ষার্থী মিলে সারা শহরেই ছিটিয়েছেন সিডবল। রাজ্যের চিক্কানা সরকারি আর্ট কলেজের এই শিক্ষার্থীরা স্বচ্ছ ভারত সামার ইন্টারশিপ কর্মসূচির আওতায় গত বৃহস্পতিবারই ১৫ প্রজাতির বীজের ৫ হাজার ১০৪টি সিডবল ছড়িয়েছেন বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। কেনিয়ায় মরুকরণ রুখতে স্কুলশিক্ষার্থীদের একটি দল গুলতিতে করে খেলাচ্ছলে ইতোমধ্যে লাখ লাখ বীজ বপন করেছে। বিবিসি অনলাইনে গত ১১ মে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, দেশটির কোমাটুর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সিডবল ছিটিয়ে মরুকরণ প্রতিরোধের কাজ করছেন ট্রেডি কিনায়ানজু। গুলতিতে সিডবলগুলো কে কত দূরে পাঠাতে পারে সেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মাত্র ২০ মিনিটেই তারা বপন করতে পারছে ২০ হাজার করে বিজ।
যুক্তরাষ্ট্রের নানা অঙ্গরাজ্যেও সিডবলে চলে বৃক্ষরোপণের উৎসব। দেশটির মিসিগান অঙ্গরাজ্যের মিসিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স টিমের এক দল গবেষক কাজ করছেন সিডবল নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে এই টিমের সদস্যরা বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিশুদের সিডবল তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এ ছাড়া দেশটির নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকার ওয়েস্টলেন সেকেন্ডারি স্কুল ও সেন্ট মেরি ক্যাথলিক ইলিমেন্টারির শিক্ষার্থীরা গতকাল ২৪ মে আয়োজন করে সিডবোম উৎসব। বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদের বীজের বল তৈরি করে শহরের রাস্তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। সে দেশে নানা জাতের ফুল ও ফসলের প্যাকেটজাত সিডবলও কিনতে পাওয়া যায়।
সিডবল তৈরির পদ্ধতি
সিডবল তৈরির পদ্ধতিটি খুবই সাদামাটা। উর্বর কাদা মাটির সঙ্গে নানা জাতের বীজ মিশিয়ে তৈরি হয় সিডবল। তবে উর্বর মাটি না পাওয়া গেলে গোবর, ভার্মিকমপোস্ট (কেঁচো সার) বা পচে যাওয়া নানা জৈব উপাদান দিয়ে মাটি তৈরি করতে হয়। এরপর মাটির ছোট দলা নিয়ে তার সঙ্গে বীজ মিশিয়ে তৈরি করা হয় বল।
বীজের আকার বা ধরন অনুসারে সিডবলের আকার বা ধরনেরও তফাত হয়। জাপান, কেনিয়া কিংবা ভারতে সিডবল তৈরি করা হয় পৃথক জাতের বীজ দিয়ে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে কয়েক জাতের শস্যবীজ একসঙ্গে ঝুরঝুরে মাটিতে মিশিয়ে একটি পাত্রে নিয়ে ঝাঁকাতে হয়। তাতে করে নরম ও আদ্র ধূলিকণা বীজের চারপাশে আবরণ হিসেবে যোগ হতে হতে গোলাকার বল হয়ে ওঠে। এ ধরনের সিডবল তৈরি করতে কখনো খড়, সুতা বা উলের উচ্ছিষ্ট ব্যবহার করা হয়। তাতে করে বলগুলো অনেক বেশি টেকসই হয়।
বাংলাদেশে সম্ভাবনা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বনাঞ্চল বাড়াতে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি চলছে। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় রাস্তা ও নদীর পাড় ধরে লাগানো হচ্ছে গাছ। তবে গাছের বা বনাঞ্চলের বড় একটা শূন্যতা দেশে এখনো রয়েছেই। তাই চলতি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির পাশাপাশি সিডবল নিয়ে নতুন কোনো কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলে বনায়নের কাজটি অনেক সহজ ও টেকসই হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নাজিমউদ্দীন মনে করেন, মাটির স্বাস্থ্য ভালো রেখে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ফসল চাষের পাশাপাশি বনায়নও হতে পারে এই পদ্ধতিতে। দেশের পার্বত্য অঞ্চল, চরাঞ্চল বা সমতলের বনভূমিগুলোতে এই পদ্ধতি বীজ বপন করে বনায়নকে টেকসই করা যায়।
তিনি মনে করেন, নদীর পাড় বা পাহাড়ের ঢালের মতো যেসব স্থানে গর্ত করে বা মাটি খুঁড়ে বীজ বপন সম্ভব নয় সেই এলাকায় এটি সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে কাজ করা সংগঠন মুক্ত কৃষির অন্যতম সংগঠক প্রতীক মোস্তাফিজ বলেন, এই পদ্ধতিতে আমরা বেশকিছু জাতের গাছ ও ফসল চাষের চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি খোলা অবস্থায় চাষ করা জমিতে বপন করা বীজের তুলনায় সিডবলের বীজের অঙ্কুরোদগমের হার বেশি। মোস্তাফিজের মতে, সিডবলে বীজগুলো পোকামাকড় বা পশুপাখিতে খেতে পারে না বলেই এ পদ্ধতিতে বীজ বপন করলে তার অঙ্কুরোদগমের হার বাড়ে।
সিডবলের ধারণা আমাদের দেশে এখনো খুব একটা পরিচিত নয়। গণমাধ্যমে এ নিয়ে লেখালেখি, স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে এই পদ্ধতিটি জনপ্রিয় করা দরকার বলে মনে করেন বীজ সংরক্ষণ ও বপনের ডাক নামের একটি সংগঠনের অন্যতম সংগঠক ও মেহেরপুরের গাড়াডোবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তোরিফা নাজমীনা। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় বনভূমির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তবে এজন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মডেল ধরে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।