পবিত্র রমজান মাসকে ঘিরে চরম উত্তপ্ত নিত্যপণ্যের বাজার। আকাশছোঁয়া দামের কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নিঃশ্বাস বন্ধের উপক্রম। যদিও বিভিন্ন সময় মন্ত্রীরা দাবি করছেন, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। বাজারে যারা বিভিন্ন নিত্যপণ্যের জোগানদার তারা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্যসহ সবধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। কেবল প্রসাধনী সামগ্রীর দাম বাড়েনি, কারণ এসব পণ্যের আকাল নেই। আর আকাল থাকবে এমনটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এসব পণ্যের ক্রেতা হচ্ছেন দেশের ধনী এবং তাদের সন্তানরা। তাই পারফিউমের দাম বাড়েনি, গাড়ির দাম বাড়েনি। বাড়েনি ধনিক শ্রেণির আনন্দ উৎসবের উপাদান।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে দাম বেড়েছে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের। সরকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সমস্যা সমাধানে বাজার মূল্য থেকে কমদামে পণ্য কিনতে ট্রেডিং কপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর মাধ্যমে ১ কোটি ‘ফ্যামিলি কার্ড’ ব্যবস্থা করেছে। এই কার্ডের মাধ্যমে অসহায় মানুষ কম দামে পণ্য কিনতে পারবেন। যাদের জন্য এই কার্ড বিতরণ করা সেই সুবিধাভোগীদের সংখ্যা এক কোটি।
সরকারের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রথম দিকে সাধারণ মানুষের ভিতরে আশার সঞ্চার করে। অনেকেই সাশ্রয়ী মূল্যের এই কার্ড পাবেন এমন আশায় বুক বাঁধতে থাকেন। কারণ, দিন এনে দিন খাওয়াদের জন্য এটি একটি মহতী উদ্যোগ বলেই তারা স্বাগত জানায়। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মালিকানা তাদের নয়, সচ্ছলদের! যাদের ভেতরে আছেন, রাজনৈতিক নেতা, আছেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আছেন কর্মচারী এমনকি দলের উপনেতা-পাতি নেতা এবং সুবিধাভোগীর দল। সেখানে ঠাঁই নেই অসহায় অসচ্ছল মানুষের। তাদের কাছে টিসিবির কার্ড মানেই সোনার হরিণ। এটা দেখা যাবে তবে ছোঁয়া যাবে না। টিসিবির কার্ড এখন শিয়াল পণ্ডিতের সেই অমর উক্তি-আঙুর ফল টক। বর্তমান সরকার দেশ এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করছেন যা কেবল দাবি নয় তাদের গৃহীত উদ্যোগ থেকেই স্পষ্ট। তারপরও সরকারের যতটুকু জনপ্রিয়তা থাকার কথা অনেকাংশে সেখানে ধস নেমেছে। কেন নেমেছে, কাদের কারণে নেমেছে এমন প্রশ্ন উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একথা স্পষ্টতর হচ্ছে সরিষায় ভূত ভর করেছে। তারা সরকারের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার করে, সরকারকেই বিপদে ফেলতে চাইছে। সরকারের অনেক সাহসী উদ্যোগকে তারা বিতর্কিত করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের লক্ষ্য কেবল সরকারকেই নয়, শেখ হাসিনার সব অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া। অর্ধশতাব্দীর পর পাওয়া একজন সফল পরপোকারী প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। এই শ্রেণিটি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আওয়ামী লীগকে হীণ স্বার্থে ব্যবহার করার এক মিশন নিয়ে।
তবে এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড মানে প্রতি পরিবার পাঁচজন সদস্য হলে ৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকারী হবেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসনের ৫৭ লাখ ১০ হাজার উপকারভোগী পরিবারের মধ্যে টিসিবি পণ্য বিক্রি করতে ‘ ফ্যামিলি কার্ড’ বিতরণ করা হয়েছে। করোনার সময় ৩০ লাখ পরিবারের সনদ সহায়তা ডাটাবেজের সঙ্গে এ ৫৭ লাখ ১০ হাজার উপকার ভোগী পরিবার যোগ করা হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রী। তিনি আরো বলেন, বলা যায় দারিদ্রসীমায় নিচে থাকা সবাই এ সুািবধা পাবেন বলে তিনি জানান।
এদিকে সরজমিনে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথার সঙ্গে বাস্তবে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টিসিবির কার্ড নিয়ে টিসিবির পণ্য নিতে এসে হালিমা খাতুন জানতে পেরেছেন, কার্ড ছাড়া পণ্য পাবেন না। কার্ড না থাকায় তিনি ফিরে যান খালি হাতে। তাঁর বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। থাকেন রাজধানীর গোপীবাগের একটা রেল বস্তিতে। পরিবারের সদস্য বলতে এক ছেলে। সেও বেকার। একাজ ও কাজ করে সংসার চালান হালিমা।
হালিমা খাতুন বললেন, কোনোরকমে বেঁচে আছেন তিনি। সংসার চলে না। আয় কম। জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। আগে টিসিবির ট্রাক থেকে তেল, ডাল, পেঁয়াজ কিনতেন। এখন সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হালিমা খাতুন। বলেন, কেউ আমার সঙ্গে কার্ডের বিষয়ে যোগাযোগ করেননি। আমি জানতামও না কার্ডের ব্যাপারে। এসব বিষয়ে আমি বুঝি না। আগে ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে কিনতে পারতাম। এখন পারছি না।
শুধু হালিমাই নন, কার্ড না পাওয়া এমন আরও বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। গতকাল রোববার সকাল ১১টার দিকে টিপু সুলতান রোড এলাকার খাদ্য ভবনের তাঁরা এসেছিলেন। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ফিরেছেন খালি হাতে। তাঁদেরই একজন বকুল রানী শীল। রাজধানীর গোপিবাগ এলাকার বাসিন্দা তিনি। বয়স পঞ্চান্নর কম নয়। তাঁর স্বামী শারীরিকভাবে অসুস্থ। আয় নেই। এক ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে কাজের সন্ধান করছেন। বকুল রানী শীল বলেন, কার্ডের জন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পাননি।
টিসিবির কার্ড পাননি এমন কয়েকজন অভিযোগ করেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের পরিচিত ব্যক্তিরাই কার্ড বেশি পাচ্ছেন। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
অনেকে কেন কার্ড পাচ্ছেন না, জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মু. মাহমুদ উল্লাহ কার্ড নেওয়ার প্রক্রিয়ার বিষয়ে বলেন, টিসিবির কার্ড নেওয়ার সুযোগ নেই। সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড কাউন্সিলদের মাধ্যমে তালিকা করে কার্ড বাসায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কাউন্সিলরা তালিকা করছেন আর্থিক অবস্থা দেখে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীই প্রাধান্য পাচ্ছেন। পাশাপাশি ওয়ার্ডগুলোতে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। কাউকে নিজ থেকে এসে যোগাযোগ করতে হচ্ছে না। তবে যারা কার্ড পাচ্ছেন না, তাদের বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করা হবে।
অপরদিকে পত্রপত্রিকার পাতায় এবিষয়ে প্রতিদিনই বিস্তর অভিযোগ উঠছে। যেখানে বলা হচ্ছে, টিসিবির কার্ডের মালিক হচ্ছেন সুবিধাবাদী সচ্ছল শ্রেণির মানুষেরা। কেউ বা দলীয় পরিচয়ে, কেউবা বিভিন্ন আঁতাতের মাধ্যমে এই সব কার্ড হাতিয়ে নিচ্ছেন। কারণ, সমাজের মানি লোকদের সম্মান বাঁচানো রাষ্ট্রের যেমন দায়, তেমনি কমিটির কর্তব্য। তাই হয়তো টিসিবির কার্ড গরিবের পর্ণ কুঠিরে প্রবেশ না করে, আলীশান বাড়ির দহজিলে তসরিফ আনছে! যেখানে গরিবেরা কেবল অপাংক্তেয় নয় অর্স্পশ্য বলে কার্ড তাদের দরজায় যেতে পারছে না। যদিও সুবিধাবাদীরা স্বর তুলে নিতে যেয়ে বার বার জাতির জনকের নামে স্লোগান দিচ্ছে। তাদের এই নোংরামিতে হয়তো জাতির জনকের আত্মা কেঁপে উঠছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটছে না।
এ ব্যাপারে দফায় দফায় টিসিবির প্রধান কার্যালয়ের সচিব মো. মনজুর আলম প্রধান এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলেন নাই। তবে তার অফিস সহকারী ( নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বলেন, ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার মালিক সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্থানীয় ক্ষমতাশালী নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী তারাই ফ্যামিলি কার্ড পাচ্ছেন বলে তিনি জানান।