একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোননয়ন বাতিল হওয়া সংক্ষুদ্ধরা প্রার্থিতা ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন। গতকাল সোমবার আপিল আবেদন করার প্রথম দিনে মোট ৮৪ জন প্রার্থী আপিল করেন। তবে আপিল সুযোগের প্রথম দিনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তিনটি আসনে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার বিরুদ্ধে কোনো আপিল করা হয়নি। দলের হেভিওয়েট খ্যাত বেশ কয়েকজন প্রার্থী ইসিতে এসে আপিল করেছেন। অন্য দিকে মনোনয়ন বাতিলের পরদিন দলের মহাসচিব পদ হারানো জাতীয় পার্টির রুহুল আমিন হাওলাদারের পক্ষেও কোনো আপিল আবেদন করা হয়নি। গত রোববার ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দিন। এদিন নির্বাচন কমিশন সারা দেশে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে বাতিল হয় ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র। আর বাতিল হওয়া প্রার্থীদের মনোনয়ন ফিরে পেতে গতকাল সোমবার থেকে ৫ ডিসেম্বর বুধবার পর্যন্ত তিন দিন আপিলের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে ইসি।
আপিল আবেদনের প্রথম দিনেই বিএনপির বাদ পড়া হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম-৫ আসনের মীর নাসির উদ্দিন, গণফোরামের হয়ে প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া ছাড়াও সদ্য বিএনপিতে যোগ দেওয়া পটুয়াখালী-৩ আসনের গোলাম মাওলা রনি, খাগড়াছড়ির আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, কিশোরগঞ্জ-২ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান রঞ্জন, সিলেট-৩ আসনে কাইয়ুম চৌধুরী, বিএনপির প্রার্থী শূন্য হওয়া বগুড়া-৭ আসনের খোরশেদ মিলটন ও ঢাকা-১ আসনের খন্দকার আবু আশফাক মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া, ঋণ ও বিল খেলাপি, আয়কর সংক্রান্ত জটিলতা, অসম্পূর্ণ ও স্বাক্ষরবিহীন হলফনামাসহ মনোনয়নপত্র জমা, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সমর্থক হিসেবে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরে মিথ্যা ও গরমিল তথ্য দেওয়ার মতো কারণগুলো আমলে নিয়ে রোববার বাছাইয়ের দিনে ৭৮৬ জনের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়াসহ সারা দেশে দলের অন্তত ৮১ জনের প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
প্রথম দিন আপিল করা প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা-১ খন্দকার আবু আশফাক, পটুয়াখালী-৩ গোলাম মাওলা রনি, বগুড়া-৪ মো. আশরাফুল হোসেন (হিরো আলম), চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ শামসুল হুদা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ তৈয়ব আলী, বগুড়া-৭ খোরশেদ মিলটন, ২৯৮ নং পার্বত্য খাগড়াছড়ি-ওয়াদুদ ভুইয়া, ঝিনাইদহ-১ আ. ওয়াহাব, ঢাকা-২০ তমিজউদ্দীন, সাতক্ষীরা-২ মো. আফসার আলী, কিশোরগঞ্জ-২ মো. আক্তারুজ্জামান, মাদারীপুর-৩ আবদুল খালেক, দিনাজপুর-২ মোকাররম হোসেন।
ঝিনাইদহ-২ আবদুল মজিদ, মাদারীপুর-৩ আবদুল খালেক, ঝিনাইদহ-২ লেফটেন্যান্ট (অব.) আবদুল মজিদ, দিনাজপুর-৩ সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, জামালপুর-৪ ফরিদুল কবির তালুকদার, পটুয়াখালী-৩ মো. শাহাজাহান, পটুয়াখালী-১ মো. সুমন, দিনাজপুর-১ পারভেজ হোসেন, মাদারীপুর-১ জহিরুল ইসলাম মিন্টু, সিলেট-৩ কাইয়ুম চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও-৩ এসএম খলিলুর রহমান, জয়পুরহাট-১ মো. ফজলুল রহমান।
পাবনা-৩ হাসাদুল ইসলাম, ফেনী-১ মিজানুর রহমান, কিশোরগঞ্জ-৩ ড. মিজানুল হক, ময়মনসিংহ-৪ আবু সাঈদ মহিউদ্দিন, নেত্রকোনা-১ মো. রুবেল ইসলাম, পঞ্চগড়-১ তৌহিদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-২ এনামুল হক খান, মানিকগঞ্জ-২ আরিফুর রহমান খান, খুলনা-২ এসএম এরশাদুজ্জামান ডলার, নটোর-১ নীরেন্দ্রনাথ শাহা, সিরাজগঞ্জ-৩ আইনাল হক, ঢাকা-১ আইয়ুব খান, বগুড়া-৩ আবদুল মুহিত, গাজীপুর-২ মাহবুব আলম।
বগুড়া-৬ এ কে এম মাহাবুবুর রহমান, রাঙামাটি-অমর কুমার দে, গাজীপুর-২ মো. জয়লান আবেদীন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ জেসমিন নূর বেবী, রংপুর-৪ মোস্তফা সেলিম, খুলনা-৬ এসএম শফিকুল আলম, হবিগঞ্জ-২ মো. জাকির হোসেন, হবিগঞ্জ-১ জোবাইর আহম্মেদ, ঢাকা-১৪ সাইফুদ্দিন আহম্মেদ, সাতক্ষীরা-১ মুজিবুর রহমান, ময়মনসিংহ-৭ জয়নাল আবেদীন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আবদুল্লাহ আল হেলাল।
ময়মনসিংহ-২ মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, শেরপুর-২ একেএম মোখলেছুর রহমান, হবিগঞ্জ-৪ মওলানা মো. সোলাইমান খান, নাটোর-৪ আলাউদ্দিন মৃধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ মো. বশির উল্লাহ, নওগাঁ-৪ মো. আফজাল হোসেন, কুড়িগ্রাম-৪ ইউনুস আলী, বরিশাল-২ আনিসুজ্জামান, ঢাকা-৫ সেলিম ভুইয়া, ঝিনাইদহ-৩ কামরুজ্জামান, মৌলভীবাজার-২ মহিবুল কাদির চৌধুরী, কুমিল্লা-৩ কেএম মুজিবুল হক, মানিকগঞ্জ-১ তোজাম্মেল হক। সিলেট-৫ ফয়েজুল মনির চৌধুরী, ময়মনসিংহ-৩ আহম্মেদ তাইবুর রহমান, চট্টগ্রাম-৫ মীর নাছির উদ্দিন, ঝিনাইদহ-৪ আবদুল মান্নান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ সৈয়দ আহম্মদ লিটন, ফেনী-৩ হাসান আহম্মদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ মামুনুর রশিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আবু আসিফ আহম্মদ, ঢাকা-১৪ জাকির হোসেন, ময়মনসিংহ-১০ হাবিবুল্লহ বেলালী, পঞ্চগড়-২ ফরহাদ হোসেন আজাদ, জামালপুর-৪ মামুনুর রশিদ। মানিকগঞ্জ-৩ আতাউর রহমান আতা, ময়মনসিংহ-৮ এমএ বাশার, ঢাকা-১৪ আবু বক্কর সিদ্দিক, বগুড়া-২ আবুল কাশেম, কুড়িগ্রাম-৩ আবদুল খালেক, কুড়িগ্রাম-৪ মাহাফুজা রহমান ও নেত্রকোনা-১ শাহ কুতুব উদ্দিন তালুকদার।
আপিলকারী মীর নাছির উদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। সরকারের চাপে রিটার্নিং কর্মকর্তা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পাবেন বলেও আশা বিএনপির এই নেতার।
তবে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার বিরুদ্ধে আপিল না করলেও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার এদিন সকালে ইসিতে আসেন। ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়ে তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, যে অজুহাতে আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে, তাহলে আমার মনে হয় না কারো মনোনয়ন টিকবে। আমার আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন, তাদের সকলের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে বিভিন্ন অজুহাতে। যারা সাধারণ নাগরিক, যারা দলের বাইরে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ছিলেন, কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে তাদের নিরুৎসাহিত করা হলো।
হলফনামায় স্বাক্ষর না করার দায়ে মনোনয়ন বাতিল হওয়া বিএনপিতে সদ্য যোগ দেওয়া গোলাম মওলা রনি সাংবাদিকদের বলেন, যে ভুলের কারণে আমার মনোনয়ন বাতিল হয়েছে, আশা করি ইসির ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তা ফিরে পাব। আগে এমন ভুল করলে যাচাই-বাছাইয়ের সময়েই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে বসেই প্রার্থীকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু এবার সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। ন্যায়বিচার পেতে আমি হলফনামার সার্টিফাইড কপি আপিলে জমা দিয়েছি।
তবে দল পরিবর্তনের কারণে তার মনোনয়ন বাতিল হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আওয়ামী লীগের সাবেক এই এমপি।
এদিকে আলোচিত ফেসবুক সেলিব্রেটি হিরো আলম প্রার্থিতা ফিরে পেতে ইসিতে আপিল করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আশা করি নির্বাচন কমিশনে ন্যায়বিচার পাব। যদি ইসি ন্যায়বিচার না করে তাহলে প্রার্থিতা পেতে আমি আদালতে যাব। মন্ত্রী-এমপিরা চায় না, রাজারা চায় না প্রজারা রাজা হোক। জিরো থেকে হিরো হয়েছি। ষড়যন্ত্র করে আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাব।
এদিকে ইসির আইন শাখার কর্মকর্তারা জানান, বিকালে আপিলকারীদের মধ্যে একজন রয়েছেন যিনি অন্যের মনোনয়নপত্র বাতিল করার জন্য স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।