আর কে চৌধুরী
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের (ইউনিডক) ২০১৮ সালের মানব পাচারবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ৫ শতাংশ নাগরিককে পাওয়া গেছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে মানব পাচারের শিকার হওয়া এসব লোক মূলত ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার লোকজন বিশ্বের ৪০টি দেশে মানব পাচারের শিকার হয়। আর ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে বাংলাদেশের লোকজনের বিদেশে পাড়ি দেওয়া থামছে না। ভাগ্য বদলাতে অনেকে দেশি-বিদেশি মানব পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছেন। এর ফলে সামপ্রতিক সময়ে মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম বারবার আসছে। বিপজ্জনক পথে মানব পাচার যে বন্ধ হয়নি, তার সর্বশেষ উদাহরণ লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশের লোকজনের নৌকাডুবির ঘটনা। মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে এ দেশের শত শত শিশু একসময় মধ্যপ্রাচ্যে উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় জকি হতে বাধ্য হয়েছে। এদের কেউ কেউ দৌড় প্রতিযোগিতার সময় আতঙ্কে প্রাণ হারিয়েছে। আর এখন ইউরোপে মানব পাচারের সময় নৌকা বা জাহাজডুবিতে যারা মারা গেছেন তার সিংহভাগ বাংলাদেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে পাঁচ বাংলাদেশি মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে এবারই প্রথম রেড নোটিশ জারি করল ইন্টারপোল। এর মধ্যে তিনজন আগে থেকে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। আর বাকি দুজনের অবস্থান সম্পর্কে এখনো কিছু জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। এর আগে মিন্টু মিয়া নামে আরো এক মানব পাচারকারীর নামে রেড নোটিশ জারি করা হয়। এ নিয়ে মোট ছয় বাংলাদেশি মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হলো। এদের নামে রাজধানীর পল্টন ও বনানী থানায় মানবপাচারের অভিযোগে ২ জুন মামলা হয়েছে। রেড নোটিশের পর ওই ব্যক্তিরা যে কোনো দেশের স্থল, নৌ ও আকাশপথের বন্দরে গেলেই গ্রেপ্তার হবেন। এরপর সে দেশের আইনকানুন পর্যালোচনা করে দেশে তাদের ফেরত আনা সম্ভব। এ পর্যন্ত ১৫ বাংলাদেশিকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা গেছে। এখন পর্যন্ত ৮১ জন মানব পাচারকারীকে চিহ্নিত করেছে সিআইডি। এর মধ্যে ৩১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর বিদেশে অবস্থান করছেন ২৭ জন। ঢাকা থেকে মানব পাচারকারী-চক্রের সদস্যরা প্রথমে ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশিদের শ্রীলঙ্কায় পাঠান। সেখান থেকে দুবাই, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া কিংবা লিবিয়ার বেনগাজিতে নিয়ে যান। এরপর সুযোগ বুঝে তাদের ইউরোপ পাঠান। এর আগে একটি ঘরে জিম্মি করে রাখেন। মানব পাচারকারীচক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করেন। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি, পাচারকারী, দালালদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পাচারের সংঘবদ্ধচক্রের বিশ্বজুড়ে বিস্তৃতি রয়েছে এবং ক্রমেই মাত্রা বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিনিয়ত এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ব্যাপকহারে মানুষ পাচার হচ্ছে। সত্যিকার পরিস্থিতিটা এই যে, কোনো সরকারই মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে নানান পদক্ষেপ নিয়েও পাচার প্রতিরোধে সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। পাচার বিষয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর তথ্য মতে—লালমনিরহাট, হিলি, কিরণগঞ্জ, সোনা মসজিদ, রাজশাহীর চরঘাট, খিদিরপুর, সাতক্ষীরা, কলারোয়া, কাকডাঙ্গা, বৈকান্দি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, চুয়াডাঙ্গা, জীবননগর, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, পাটগ্রামের সীমান্ত এলাকা ইত্যাদি নারী ও শিশু পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। মোটা অঙ্কের বেতনের লোভ দেখিয়ে সমুদ্রপথে মানুষ পাচারের ঘটনা বেশি হচ্ছে। পাচার হওয়ার পথে অনেকে সাগরে দস্যুদের কবলে পড়ে বা নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে; কিংবা আটক হয়ে বিদেশের জেলে বন্দি থাকছে। যারা পাচার হতে পারছে তারা মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে শ্রমদাসে পরিণত হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০০৩ সালে বহুজাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধবিষয়ক আইন প্রণয়ন করেছে। এর ফলে মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে আমাদেরও উদ্যোগী হতে হবে।
অবৈধ বিদেশযাত্রা ও মানব পাচার রোধে প্রথমত সরকারকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। প্রতারক ও পাচারচক্রকে ধরতে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সমুদ্রপথে পাচার রুটগুলোতে টহল নজরদারি আরো জোরদার করতে হবে। পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আটক করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অবৈধ বিদেশ গমনের ঝুঁকি ও পাচারের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। একাজে গণমাধ্যম, এনজিও, সামাজিক সংগঠনগুলোকেও কাজে লাগানো দরকার। আর গুরুত্বপূর্ণ হলো বৈধ পথে ন্যায্য খরচে বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ বাড়াতে হবে এবং এ সম্পর্কে গণমানুষকে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল করতে হবে।
জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান যেমন অনস্বীকার্য তেমন আদম বেপারি নামের প্রতারকদের প্রতারণাও অনেক বিয়োগান্ত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। বিদেশে চাকরি দেওয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও, চাকরি না দিয়ে প্রতারণা শুধু নয়, জীবন কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেলেও থেমে নেই মানব পাচারের ঘটনা। লিবিয়া থেকে নৌকায় ইউরোপে সাগর পাড়ি দেওয়ার ঘটনা বেড়েছে ব্যাপকহারে। চলতি বছর বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে নৌকায় করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। আশ্রয় পাওয়ার জন্য এমন সব কারণ দেখানো হচ্ছে যা বাস্তবতাবিবর্জিত এবং দেশের জন্য অসম্মানজনক। মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এ ঘৃণ্য অপরাধে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাই সব কথা নয়।
বাংলাদেশি নাগরিকদের মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ার কারণ হিসেবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের মত হচ্ছে, ‘অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি হয়তো চায়ের দোকানে কিংবা অ্যাপভিত্তিক পরিবহন যাত্রীসেবায় লোকজনের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে। কিন্তু বিদেশগামী তরুণেরা আসলে কী ধরনের কাজ চান, সেটা আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। তারা নিজেদের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ চান। মর্যাদাসম্পন্ন কাজ চান। আমরা কি সেটা দিতে পারছি? তাই ঝুঁকি নিয়ে তারা বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রবৃদ্ধির উচ্চহার দিয়ে এটা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়।’ সুতরাং এসব বিষয় নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে আমাদের নীতিনির্ধারকদের।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ