ফিচার

প্রশাসন চুপ, পরিবহন মালিকরা নির্বিকার

  • রহিমা আক্তার মৌ
  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল, ২০১৯

হঠাৎ দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা এত বেড়েছে যে, রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ হাত হারাচ্ছেন, কেউ হারাচ্ছেন পা। জীবন হারানোর হিসাব তো কেউ করে না। দুই বাস চালকের প্রতিযোগিতায় যে হারুক আর যে জিতুক জীবন-যুদ্ধে হেরে গেল রাজীব হোসেন। দুই ড্রাইভারের কারণে ছেলেটি প্রথমে একটি হাত হারিয়েছিল; পরে জীবন। ঘর থেকে বের হওয়াই যেন কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে সাধারণ মানুষের। কিন্তু প্রতিকারের কোনো আলামত তো দেখি না আমরা। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকার তৎপর হলে পরিবহন মালিকরা বিগড়ে বসেন, পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দেন। বাসচালক ও শ্রমিকদের বেপরোয়া মানসিকতার কারণে জীবন হারাচ্ছে মানুষ। এগুলোকে দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে, এটা হত্যাকাণ্ড। অথচ আমাদের প্রশাসন চুপ, আমাদের পরিবহন মালিকরা নির্বিকার।

১৯৯৫-৯৬ সাল থেকেই সাভার সিআরপি পক্ষাঘাত হাসপাতালে যাওয়া-আসা আমার। ইমিডিয়েট ছোট ভাই সেখানে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট বিভাগে ভর্তি হয়। সিআরপির ভেতরের পরিবেশ অসাধারণ, আমরা ছুটি পেলেই বিকালে যেতাম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। ওখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে অনেক কথা হতো আমার। যারা সিআরপিতে গিয়েছেন তারা ভেতরের পরিবেশ দেখেছেন। দেখেছেন হুইল চেয়ারের ব্যবহার, দেখেছেন খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা। পা নেই হাতকে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করছেন। হাতের ওপর ভর করেই করছেন অফিসিয়াল কাজ। ওদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই জেনেছি, অধিকাংশ ব্যক্তিই দুর্ঘটনার শিকার। দুর্ঘটনায় কারো প্রাণ গেলে সে চলে যায়, অসহায় হয় তার পরিবার। আর কেউ আহত হয়ে অঙ্গ হারালে সে হয়ে যায় অন্যের বোঝা। পরিবারের একজন ব্যক্তি পঙ্গু হলে পুরো পরিবার পঙ্গু হতে বসে। কর্মক্ষম ব্যক্তি অচল হয়ে নিঃস্ব করে দেয় পুরো পরিবারকে।

গত বছর ২৩ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে পলাশী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন। সাড়ে ৮টার দিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহন করা বাস (ঢাকা মেট্রো চ-০৮-০০৫৩) নীলক্ষেতের দিক থেকে উল্টোপথে পলাশী হয়ে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছিল। এতে পুলিশ বাধা দিলে চালক নজরুল ইসলামসহ বাসের হেলপার ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান। ওই সময় কিছুটা দূরে ছিলেন পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন। ঘটনাটি চোখে পড়তেই তিনি ছুটে যান। তার সঙ্গেও তর্কে জড়ান বাসের লোকজন। এমনকি পুলিশের পোশাক ধরেও টানাটানি করেন তারা। এরই একপর্যায়ে চালক বাসটি চালিয়ে দেয়। এতে দেলোয়ারের বাঁ পা বাসের চাকার নিচে পড়ে থেঁতলে যায়। চিকিৎসকরা দেলোয়ারের বাঁ পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। পরিবার তার পা রক্ষার চেষ্টা করতে থাকে। এর মধ্যেই তিনি হূদরোগে আক্রান্ত হন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ২৫ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করা দেলোয়ার চার মেয়ের জনক। সবচেয়ে ছোট মেয়েটির বয়স চার মাস। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের আনন্দ উৎসবের সময় মহামারী আকার ধারণ করছে। মুহূর্তের মাঝে কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। পঙ্গু করে দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে। গবেষণায় দেখা যায় দেশে যত পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ মানুষ রয়েছে তার প্রায় ৭০/৭৫ ভাগই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। ঘরের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি পঙ্গু হলেই পুরো পরিবারই পঙ্গু হয়ে যায়। বেপরোয়া গাড়ি চালানোই দুর্ঘটনার মূল কারণ হলেও এমন অনেক বিষয় আছে যা আমরা দেখেও এড়িয়ে চলি। একই পথে ছোট-বড় গাড়ি চলে, রাতের বেলায় হেডলাইট জ্বালানো হয়। বড় গাড়ির হেডলাইট থাকে উপরে ছোট গাড়ির হেডলাইট থাকে নিচের দিকে। বিপরীত দিক থেকে আশা বড় গাড়ির হেডলাইটের জন্য অন্য পাশের ছোট গাড়ির চালক কিছুই দেখতে পায় না। এর ফলে  অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনা এড়াতে রাস্তার লেন আলাদা করতে হবে। শুধু আলাদা নয়, দুই বা চার লেনের মাঝে জায়গা রাখতে হবে।

উৎসবের সময় যাত্রীর যেমন চাপ থাকে যেনতেন গাড়ি নামানো হয়, হেলপার দিয়ে চালানো হয়। হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্ব এগুলো দেখা, টাকা খেয়ে তারা গাড়ি ছেড়ে দেয়। এইসব তদারকি করতে হবে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বড় গাড়িতে দুজন করে চালক রাখার নিয়ম করতে হবে। ছোট ছোট ব্যক্তিমালিকানা গাড়ি যেমন কার, মাইক্রো চালানোর জন্য লেন আলাদা করতে হবে। কোনোক্রমেই গাড়ির গতি ৮০-এর ওপরে উঠতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে প্রতিটি গাড়িতে গতি ক্ষমতা কমিয়ে দিতে হবে।

উৎসবগুলোতে ছুটি আগে-পিছে করে দিতে হবে। তাহলে যাত্রীর চাপ কম হবে। এমন অনেক রাস্তা আছে যে রাস্তায় লাইট নেই। রাতের বেলায় ভুতুড়ে অবস্থা হয়। সেইসব রাস্তায় লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে আইনের কোনো অভাব নেই। কিন্তু আইন কার্যকরী হচ্ছে না। দুর্ঘটনার পর চালক পালিয়ে যায়, এর দায়িত্ব গাড়ির মালিককে নিতে হবে। সেখানেও ক্ষমতায়ন কাজ করে।

দেশের সব রাজনীতিবিদ এখন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই মিলিত ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের জন্যই আইনের ফাঁকগুলো সহজ হয়ে যাচ্ছে। কথায় আছে ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’। কিন্তু মাইর দেওয়ার শক্তিই যখন হারায় আইন তাহলে যতই নিয়ম করা হোক কাজ কিচ্ছু হবে না।

 

লেখক : গদ্য লেখক

rbabygolpo710@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads